Archiveবেঙ্গল লাইভ Special

কুয়াশায় ঢাকা বোবা আলো আর দার্জিলিং: ষষ্ঠ কিস্তি

Nblive বিশেষ প্রতিবেদনঃ

স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষ ও দার্জিলিং:

স্বাধীনতার পর দার্জিলিংকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আলাদা একটা জেলা করা হয়, যার সাথে অন্যান্য পাহাড়ি শহর কার্শিয়ং, কালিম্পং ও তরাই অঞ্চল ( শিলিগুড়ি) যুক্ত করা হয়। People Liberation Army যখন তিব্বতে অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন হাজার হাজার তিব্বতিরা উদ্বাস্তু হিসেবে দার্জিলিংয়ে আশ্রয় নেয়।

দার্জিলিং শহর – যা ছিল সাহেবদের উপনিবেশ, মূলত ১০,০০০ মানুষের বসতির জন্য বানানো হয়েছিল। কিন্তু দার্জিলিংয়ের দ্রুত গতিতে বিকাশের জন্য আশপাশের পাহাড়ি অঞ্চল ( নেপাল, ভূটান, সিকিম, তিব্বত) থেকে প্রচুর মানুষ কাজের সন্ধানে দার্জিলিংয়ে পাড়ি দিচ্ছিলেন। ভৌগলিকভাবে দার্জিলিং ছিল সদ্য গড়ে ওঠা শহর,কিন্তু সেখানে যেভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই জনসংখ্যার বিপুল দৌড়ের ফলে চাপ বাড়তে থাকে। তাতে শহরের পরিবেশে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার প্রবণতা জন্ম নেয়। তার ওপর রয়েছে বিপুল সংখ্যক পর্যটকদের আনাগোনা এবং যথেচ্ছ হারে প্লাস্টিকের ব্যবহার। এর ফলস্বরুপ দার্জিলিংয়ের জীববৈচিত্র‍্য ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।

জাতিগত বৈচিত্র‍্য ও সমস্যা: 

দার্জিলিংয়ে লেপচা, ভুটিয়া, গোর্খা সহ বিভিন্ন দেশীয় জাতির লোকের বসবাস। এই যে বিভিন্ন প্রকার জাতির একসাথে বসবাস, তাদের জীবনশৈলী, খাদ্যাভ্যাস, লোকাচার, কৃষ্টি, সংস্কৃতি প্রমুখ উপাদানগুলি দার্জিলিংকে সমৃদ্ধ করেছে। আবার এগুলিই বর্তমানে আশঙ্কার মেঘরূপে দেখা দিয়েছে। এই যে জাতিগত বৈচিত্র্য, একেই ইস্যু করে গোর্খাল্যান্ড বা কামতাপুর সহ জাতিগত রেখাগুলি তীব্র সমস্যা ধারণ করে আশির দশকে।

উত্তাপের শুরুয়াৎ:

এই সমস্যা মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেল ফ্রন্ট(GNLF) ৪০ দিনের টানা ধর্মঘট ও রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে পাহাড় অচল করে তোলে। গোর্খাদের নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবীতে জিএনএলএফ সুপ্রিমো সুভাস ঘিসিংর নেতৃত্বে পাহাড় জুড়ে শুরু হয় হিংসাত্মক আন্দোলন। ক্রমশ রাজনৈতিক পরিবেশ তীব্র উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

রফাসূত্রের মতো একটা কিছু:

অবশেষে প্রশাসনের সাথে বৈঠক করে একটা রফাসূত্র বেরিয়ে আসে। ফলস্বরুপ ১৯৮৮ সালে “দার্জিলিং হিল কাউন্সিল ” তৈরি হয় সুভাস ঘিসিংর সভাপতিত্বে। সুষ্ঠভাবে জেলা পরিচালনার জন্য তাদের স্বশাসিত মর্যাদা দেওয়া হয় ও যাবতীয় ক্ষমতা তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি পাহাড়ের উন্নয়নকল্পে প্রচুর অর্থও বরাদ্দ করা হয়।

উত্তাপের নেক্সট ইনিংস… অচলাবস্থা:

বেশ কয়েক বছর শান্তি থাকার পর পাহাড়ে অশান্তির মেঘ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আলাদা রাজ্য গোর্খাল্যান্ড”-এর দাবীতে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে, যখন, জিনএনএলএফ থেকে সৃষ্টি হওয়া আরেকটি নতুন রাজনৈতিক দল “গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা” আত্মপ্রকাশ করে বিমল গুরুংয়ের নেতৃত্বে। আলাদা রাজ্যের দাবীতে ঘিসিং প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় গুরুংয়ের নেতৃত্বে পাহাড়বাসী আবার আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। ঘিসিংয়েরই একদা শিষ্য গুরুংয়ের জঙ্গি আন্দোলনের ফলে পাহাড়ে অচলাবস্থা জারি হয়। টানা বনধের জেরে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়। নতুন শতাব্দীতে এসে হঠাৎ করে এই আন্দোলন প্রশাসনকে আবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

Gorkha Territorial Administration (GTA): 

দীর্ঘ আন্দোলন ও রাজনৈতিক টানাপোড়নের পর অবশেষে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আগের দার্জিলিং হিল কাউন্সিল বাতিল করে তার পরিবর্তে Gorkha Territorial Administration (GTA) নামক এক নতুন অর্ধ-স্বশাসিত পর্ষদ গঠন হয়। যেখানে সমতল বাদ দিয়ে ( শিলিগুড়ি) তরাই সহ, কার্শিয়ং, মিরিক মহকুমা হিসেবে ও দার্জিলিং সদর রূপে ঘোষিত হয়।

“নটে গাছটি বুড়িয়ে ওঠে কিন্তু মুড়োয় না”

মাঝে কিছু বছর “পাহাড় হাসছিল”, কিন্তু পাহাড়ের রাজনীতি যে পাহাড়ের আবহাওয়ার মতোই, এই রোদ – এই কুয়াশা। যতবারই তাদের নতুন করে, নতুন নামে ক্ষমতা দেওয়া হয়, বেশ কয়েকবছর শান্তি থাকে তারপর আবার নতুন করে পাহাড়বাসী তাদের “গোর্খাল্যান্ড” নামক ” তাস” ঝুলি থেকে বের করে। আগেই বলেছি, দার্জিলিং আসলে ‘গেম অফ থ্রোনস’, বারে বারে, কালে কালে কখনো নেপাল, কখনো সিকিম, লেপচা-ব্রিটিশ হয়ে আজকের গোর্খা… ইতিহাসের ট্র‍্যাডিশন সমানে চলছেই…
আসলে “নটে গাছটি বুড়িয়ে ওঠে কিন্তু মুড়োয় না”

চলবে…

Back to top button