তুলাইপাঞ্জির মাথায় জিআইয়ের মুকুট,গর্বিত জেলাবাসী
Nblive রায়গঞ্জঃ রাজ্যবাসীর মন জয় করে নেওয়া তুলাইপাঞ্জি চাল পেল জি আই ট্যাগ। সম্প্রতি এই রাজস্ব বছরের জি আই ট্যাগ প্রাপ্ত দ্রব্যগুলির ঘোষনা করা হয়, যেখানে সারা দেশের ৭ টি দ্রব্যকে জি আইয়ের তকমা দেওয়া হয়। ফলত তুলাইপাঞ্জির ভৌগলিক স্বীকৃতি প্রাপ্তিযোগ হল একথা হলফ করে বলা যায়। তুলাইপাঞ্জির সাথে সাথে গোবিন্দভোগ চালও এবারে জি আইয়ের মর্যাদা পেয়েছে।
জি আই কি ?
জি আইয়ের গোদা ‘বাংলা’ করলে দাঁড়ায় জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন। মূলত কৃষিজাত, প্রাকৃতিক, বা কোন প্রস্তুতকৃত দ্রব্য ( হাতে তৈরী বা শিল্পগত) যা একটিমাত্র নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ, সেই দ্রব্যের ভৌগলিক পরিচিতিকেই জি আই বলে।
সাধারণত জি আই মর্যাদাপ্রাপ্ত কোনো দ্রব্যের উৎকর্ষতা শ্রেষ্ঠতার পরিচায়ক এবং সেটির মধ্যে দিয়ে সেই ভৌগলিক স্থানের পরিচিতি ঘটে থাকে। জি আই ট্যাগ পাওয়া কোনো দ্রব্য একমাত্র সেই স্থানেই লভ্য, অন্য কোথাও নয়। অর্থাৎ তুলাইপাঞ্জির চালের জি আই লাভের পর এটি একমাত্র রায়গঞ্জেই পাওয়া সম্ভব, অন্য কোনো জায়গায় নয়। ফলত অসাধু উপায়ে বা নকল ভাবে তুলাইপাঞ্জি চাল তৈরি করা যাবে না বা বিক্রিও করা যাবে না।
এর আগে এ রাজ্য থেকে ১২ টি দ্রব্য জি
আই পেয়েছিল। দার্জিলিং চা, ফজলী, হিমসাগর, জয়নগরের মোয়া বালুচরি – ধনেখালি সহ বিভিন্ন দ্রব্য স্থান পেয়েছিল। এবারে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল ১৪ তে।
জেলা কৃষি দফতরেএ অধিকর্তারা যারপরনাই খুশি। এক কর্মী জানালেন জি আই ট্যাগের ফলে যেমন এই চালের গুণমান রক্ষা করা যাবে তেমনি এর ফলে এই চালের দাম বাড়বে। ফলে চাষিরা এই ধান চাষ করে লাভবান হবেন। সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে এই সুগন্ধি চালের পরিচিতি পৌঁছবে।
এক নজরে দেখে নিন তুলাইপাঞ্জির কিছু কথাঃ
বিন্দোলে ৪০০ বছর আগে প্রথম চাষ।
উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ, ইটাহার ব্লকে এই ধানের চাষ হয়।
এই চালের খ্যাতি তার অপূর্ব গন্ধের জন্য।
জেলায় প্রতি বছর গড়ে ৬ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমিতে ১২ হাজার টন ধানের চাষ হয়।
চাষিরা প্রতি মণ ধান ১২০০ – ১৪০০ টাকায় বিক্রি করেন।
বিঘা প্রতি লাভের পরিমাণ ৬০০০-৭০০০ টাকা।
২০১৬ সালের অলিম্পিকেও খাবারের জায়গায় স্থান করে নিয়েছেইল এই সুগন্ধি চাল।
কি করে চিনবেন ?
আসলঃ
১।গাছের উচ্চতা ১৫০ থেকে ১৫৫ সেন্টিমিটার হবে।
২। গাছের রং হলদে সবুজ হবে।
৩। ধান পাকতে ১৫০ থেকে ১৬০দিন সময় নেয়।
৪। ১ কুইন্টাল ধান ভাঙালে ৫০ থেকে ৫৪ কেজি চাল মিলবে।
৫। অ্যামাইলোজের উপস্থিতির কারণে ভাত ঝরঝরে থাকবে।
৬। আলোক সংবেদনশীল হবার কারণে যখনি বপন করা হোক না কেন নির্দিষ্ট সময়ের আগে ফুল আসবেনা।
৭। চাল হাতে নিয়ে ঘষলে গন্ধ মিলবে।
৮।ভাত রান্না করে দীর্ঘ সময় রেখে দিলেও এলিয়ে যাবেনা।
নকলঃ
১। গাছের উচ্চতা ১৩০ থেকে ১৩৫ সেন্টিমিটার হবে।
২। গাছের রং হলদে সবুজ হবে।
৩। ধান পাকতে ১৪০ থেকে ১৫০দিন সময় নেয়।
৪। ১ কুইন্টাল ধান ভাঙালে ৫৫ থেকে ৬০ কেজি চাল মিলবে।
৫। অ্যামাইলোজের উপস্থিতি না থাকার কারণে ভাত ঝরঝরে থাকবে না ।
৬। শারীরবৃত্তীয় পরিপক্কতা এলেই ৪০ দিনের মাথায় ফুল আসবে।
৭। চাল হাতে নিয়ে ঘষলে গন্ধ মিলবে না।
৮। ভাত রান্না করে দীর্ঘ সময় রেখে দিলে এলিয়ে যাবে।
তুলাইপাঞ্জি চালের ইতিহাসঃ
তুলাই চালের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্বকথা ও মতামত রয়েছে, যদিও অবিভক্ত দিনাজপুরে তুলাই নদীর দুই ধারের উঁচু ভাঙ্গা জমি গুলিতে তুলাই পাজা ধানের চাষ ব্যাপক পরিমাণে হবার কারণেই তুলাই চাল নামকরণ হয়েছে বলে বহুল প্রচলিত।বর্তমানে এই নদীর জল শুকিয়ে নদীর নাব্য প্রণালী ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
অভিধানে তুলাই নামক কোন শব্দ পাওয়া যায়নি। তবে তুলাই অথবা তুলাসালি নামে একটি ধানশস্যের পরিচয় পাওয়া যায়। যা অতি কোমল ও সুগন্ধি তুলার মত নরম। এই তুলন বা তুলাসালি ধানশস্যটিই তুলাই পাজা নামে পরিচিত।আমাদের ভাষার ধ্বনীতত্ত্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে তুলন থেকে তুলনই থেকে তুলাই হয়েছে। আর পাজা শব্দের অর্থ আঁটি যা বর্তমানে অপভ্রংশ হয়ে পাঞ্জা অথবা পাঞ্জি নামে পরিচিত হয়েছে।
শ্রাবন মাসের ১৫ তারিখ থেকে ভাদ্রে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে গচুবনা পুজোর মাধ্যমে তুলাই ধানের রোয়াগারা সম্পন্ন হয় । প্রকৃতির ঋতু বৈচিত্রের মতোই ধানের ভুবনে তুলাইপাঞ্জা বর্ণময় ও বৈচিত্র্যময়। ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পণ্ডিত রামাই লিখিত শূণ্যপুরান ও সন্ধ্যাকর নন্দী লিখিত রামচরিতেও তুলাইয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধানশস্য সম্পর্কে দিনাজপুর জেলার মানুষের যে সব ধারণা,বিশ্বাস,সংস্কার,সতর্কতা,নিষেধ রয়েছে সেই সময় লোকশ্রতি প্রবাদে তার নিদর্শণ পাওয়া যায়। যেমন –
“ঝাকে ঝাকে পাখি পরে, তুল পুঞ্জ আহার আপনি করে, তুলধান তুলধান, যেই জানে সেই মান,মাছ খামু চিতল ভাকুর,গচি ফেলামু তুলাই ঠাকুর।”
এছারাও বেশ কিছু লোক সঙ্গীতের প্রচলনও পাওয়া গিয়েছে।