পালা বদলের ২০১৭, ফিরে দেখা দার্জিলিঙ
Nblive দার্জিলিঙঃ চার দশকেরও বেশি সময় পর গত ৮ জুন পাহাড়ে ক্যাবিনেট বৈঠকের আয়োজন করে রাজ্য সরকার। সেই বৈঠক চলাকালীনই ভানু ভবনের সামনে মোর্চার আন্দোলনকে ঘিরে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় দার্জিলিঙে। শুরু হয় মোর্চা পুলিশ খন্ড যুদ্ধ। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় একের পর এক পুলিশের গাড়ি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে পাহাড় উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় বিপাকে পড়ে জেলা পুলিশ। বদলি করা হয় দার্জিলিঙের পুলিশ সুপারকে। এদিকে মোর্চার বিক্ষোভের জেরে ভেঙে পড়ে পাহাড়ের স্বাভাবিক জনজীবন। দশ হাজারেরও বেশি পর্যটক আটকে পড়ে পাহাড়ে। ১২টিরও বেশি পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পঞ্চাশেরও বেশি পুলিশ কর্মী আহত হন ঘটনায়।
মোর্চার তরফ থেকে ডাক দেওয়া হয় ১২ ঘন্টার ধর্মঘট। এদিকে মোর্চার ডাকা পাহাড় বনধকে ব্যর্থ করতে তোড়জোড় শুরু হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। নামানো হয় কেন্দ্রীয় বাহিনী। কিন্তু তাতেও প্রাথমিক পর্যায়ে রোধ করা সম্ভব হয়নি মোর্চার বিক্ষোভ। মোর্চা সুপ্রীমো বিমল গুরুঙের নামে দার্জিলিঙ থানায় দায়ের করা হয় মামলা। পাহাড়ে আটকে থাকা পর্যটকদের ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ব্যবস্থা করে রাজ্য সরকার। কড়া পুলিশি প্রহরায় বাসে করে পাহাড় থেকে পর্যটকদের নামিয়ে আনে প্রশাসন।
এদিকে মোর্চা সুপ্রীমোর খোঁজে পাহাড়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। পাতলেবাস মোর্চার সদর দফতরে হানা দিয়েও খোঁজ পাওয়া যায় নি তার। গোপন ডেরা থেকেই মোর্চাকে নেতৃত্ব দিতে থাকেন বিমল গুরুঙ। এদিকে পাহাড়ের উত্তাপ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমতল থেকে জেলার অন্যান্য অঞ্চলে। সংবাদ পত্রের গাড়ি, সরকারি বাস, কালিম্পং-এর সেরিকালচার অফিস, পেডং পুলিশ আউট পোস্ট, গয়াবাড়ি, সোনাদা রেলস্টেশন ভস্মীভূত হয়ে যায় আগুনে। ডাক দেওয়া হয় অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘটের।
১০৪ দিন ধরে পাহাড়ে ধর্মঘট চলার মাঝেই দফায় দফায় উত্তপ্ত হয় দার্জিলিঙ, তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল। ইতিমধ্যেই ধর্মঘট জারি রাখা ও প্রত্যাহার করা নিয়ে দুই ভাগ হয়ে পড়ে মোর্চা। গ্রেফতারি এড়াতে পাহাড় ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন বিমল গুরুঙ। ক্ষমতা ধরে রাখার উদ্দেশ্যে সেখান থেকেই কখনও ভিডিও কখনও বা অডিও ক্লিপ প্রকাশ করে মোর্চা সমর্থকদের গোর্খাল্যান্ডের দাবীতে আন্দোলন জারি রাখার বার্তা দিতে থাকেন গুরুঙ। কিন্তু রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক চালে কোণঠাসা পরিস্থিতি হতে থাকে গুরুঙের। নতুন মোর্চা নেতার জায়গা নিতে শুরু করেন গুরুঙের একসময়ের ছায়াসঙ্গী বিনয় তামাঙ, অনিত থাপারা। একদিকে বনধের সমর্থনে মিছিল শুরু হয় বিমল পন্থীদের, অন্যদিকে বনধ তুলে নেওয়ার পক্ষে মিছিল করতে থাকে বিনয় তামাঙ গোষ্ঠী।
এদিকে সিকিম পাহাড় লাগোয়া সিংলার জঙ্গলে বিমলের লুকিয়ে থাকার খবর পেয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সাথে নিয়ে হানা দেয় রাজ্য পুলিশ। গুরুঙের গোপন ডেরা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হলেও জঙ্গল ছেড়ে পালাতে সক্ষম হন বিমল গুরুঙ। কিন্তু দুই পক্ষের গুলির লড়াইতে প্রাণ হারান পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিক। আরও তোড়জোড়ে শুরু হয় দার্জিলিঙ, কার্শিয়ঙ ও কালিম্পঙে তল্লাশি। জিলোটিন স্টিক সহ বিপুল পরিমাণে উদ্ধার হতে শুরু করে বিস্ফোরক। গ্রেফতার করা হয় একের পর এক বিমল ঘনিষ্ঠ মোর্চা নেতা।এদিকে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে রাজ্যের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠক প্রাথমিক পর্যায়ে বিফলে গেলেও পরবর্তীকালে বিনয় তামাঙ ও অনিত থাপা গোষ্ঠীর তৎপরতায় পাহাড়ে কোণঠাসা পরিস্থিতি হয় গুরুঙ পন্থীদের। জিটিএ-তে প্রশাসক পদে বসানো হয় বিনয় তামাঙকে।
পাকাপাকি ভাবে না হলেও মোর্চা সুপ্রীমো বিমল গুরুঙের নিখোঁজ হয়ে থাকার কারণে সাময়িক ভাবে শান্তি ফিরে এসেছে পাহাড়ে। তবে ২০১৭ সালে পাহাড় পেল নতুন এক নেতা। সুভাষ ঘিষিঙের পর পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবীর আন্দোলনকে সামনে রেখে নেতা হয়েছিলেন বিমল গুরুঙ। কিন্তু ২০১৭ সালের ভয়াবহ আন্দোলন কেড়ে নিয়েছে তাঁর নেতৃত্ব। পাহাড় পেয়েছে নতুন নেতা।