Archiveপোর্টজিন

হুল দিবসঃ স্মরণে শ্রদ্ধায় সাঁওতালদের মুক্তির সংগ্রাম — গৌতম কুমার দাস

Nblive পোর্টজিনঃ

হুল দিবসঃ স্মরণে শ্রদ্ধায় সাঁওতালদের মুক্তির সংগ্রাম

— গৌতম কুমার দাস

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ বা ‘হুল বিদ্রোহ’ একটি বিশেষ উজ্জ্বলতম অধ্যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের প্রথম সংগঠিত প্রতিবাদ ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল, মুসলমান ও গরিব হিন্দু জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং অসৎ ব্যবসায়ী ও সুদখোর মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতন থেকে নিজেদের রক্ষা করার লড়াইয়ের অন্যতম দিনটির নাম ‘হুল’ দিবস।

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনার চার ভাই সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব ও তাঁদের দুই বোন ফুলমনি ও জান মুর্মুর নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল অত্যাচারী ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদ ও জমিদার-সুদখোর মহাজনদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ গণ পদযাত্রার সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে সাঁওতালদের এই গণ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন কুমার, তেলী, কর্মকার, চামার, ডোম, মোমিন সম্প্রদায়ের গরিব হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণ। সাঁওতালদের এই পদযাত্রার কথা শুনে শোষক শ্রেণীর মহাজন জমিদাররা ভীত হয়ে পড়েন। ৭-ই জুলাই মহেশলাল দারোগা সিধু ও কানুকে চুরি-ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করতে গেলে বিদ্রোহের আগুন দাবানলের মত জ্বলে ওঠে এবং বিদ্রোহীরা দারোগা সহ ১৯ জনকে হত্যা করে।
কানু ঘোষণা দেন- ‘হুল বিদ্রোহ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। চারিদিকে শালের ডাল পাঠাইয়া দাও। এখন আর কোন হাকিম নেই, দারোগা নেই, সরকার নেই, আমাদের রাজা আসিয়া গিয়াছে’।
তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “আবুয়া দিশম আবুতেবুন চালাওয়া”। অর্থাৎ আমাদের দেশ আমরাই পরিচালনা করবো। এই বিদ্রোহের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং অসৎ ব্যবসায়ী ও সুদখোর মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। শুরু হয় পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের লড়াই। এই বিদ্রোহে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ যোগ দেয়। এই গণঅভ্যুত্থানের ফলে ইংরেজ সরকারের থানা, সেনাদের ঘাঁটি, নীলকরদের কুঠি আক্রমণ এবং জমিদার ও মহাজনদের ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সমগ্র অঞ্চল সাঁওতালদের দখলে চলে যায়। অবশেষে ইংরেজ সেনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৫ হাজার সেনা, অশ্বারোহী বাহিনী, কামান বাহিনী দ্বারা বিদ্রোহ দমনের অভিযান চালায়। ভীষণ বর্বর ভাবে ইংরেজ বাহিনী একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ইংরেজ বাহিনীর কামান ও বন্দুকের সামনে সাঁওতালরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করলেও শেষপর্যন্ত গভীর জঙ্গলে চলে যেতে বাধ্য হয়। সাঁওতালদের পরাজয় ঘটে। প্রায় ২৫০০০ সাঁওতাল প্রান হারায় ও কয়েক হাজার গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়। ভাগলপুরে এক ভয়ানক যুদ্ধে বিদ্রোহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক চাঁদ-ভৈরব প্রান বিসর্জন করেন। এই বিদ্রোহের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা সিধু মাঝিকে কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়।

১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৮৬৬ সালে বীরভূম জেলায় এই বিদ্রোহের প্রধান নায়ক কানুকে ইংরেজ সরকার গ্রেপ্তার করে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ নিপিড়ীত মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস। সাঁওতাল জাতির ইতিহাসে ‘হুল’ ছিল সর্বাধিক বৃহত্তম এবং গৌরবের বিষয়। ঐতিহাসিক সাঁওতাল ‘হুল’ এর অবসান হলে ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের জন্য একটি জেলা বরাদ্দ করেছিল। এই জেলার নাম হলো ডুমকা। এই জেলাই সাঁওতাল পরগণা নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ প্রমান করে দিয়েছে শাসক যতই শক্তিশালী বা নিষ্ঠুর হোকনা কেন গণআন্দোলনের ভীত শক্ত থাকলে শাসকের পরাজয় ঘটবেই। যে সাঁওতাল জাতি ভারতবর্ষের মুক্তি সংগ্রামের পথ দেখিয়েছে সেই সাঁওতালরা আজও অবহেলিত। শাসক বদলেছে, শোষকের চরিত্র বদলেছে শুধু বদলায়নি সহজ-সরল সাঁওতালদের জীবনযাত্রা। মুক্তির সংগ্রাম কোনোদিন শেষ হয়ে যায়না…
———————————

Related News

Back to top button