Archiveরায়গঞ্জ

অর্কিড প্রেমে মগ্ন রায়গঞ্জের বধূ, ব্যবসায় লক্ষ্মী আসছে ঘরে

রায়গঞ্জঃ ফ্র‍্যাগ্মিপেডিয়াম, কোভাচি, এংরাকিয়াম-সেস্কুইপেডালে ভার বসেরি, ফেলোনপসিস ইকুয়েস্ট্রিস থ্রি-লিপস। নামগুলোর সাথে হয়তো পরিচিত নন অনেকেই। অথচ এদের সঙ্গেই নিত্য প্রেম রায়গঞ্জের আটপৌরে গৃহবধূ রুমকি মোদকের। আসলে এগুলো একেকটি দুর্লভ প্রজাতির অর্কিডের নাম। প্রাচ্যের সুদূর থাইল্যাণ্ড ও তাইওয়ান থেকে উড়িয়ে এনে নিজের ঘরে বসিয়েছেন তাদের। গৃহকোণে থাকা এই সবুজ সুন্দরীদের সৌজন্যেই রায়গঞ্জের রুমকি দেবী আজ দেশ-বিদেশের অর্কিড প্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। উত্তরের এই ছোট্ট শহরকেই তিনি করে তুলেছেন বিখ্যাত। শুধু সবুজের সমারোহ নয়, সখের অর্কিড চাষে লক্ষ্মীলাভও হয়েছে রুমকিদেবীর। এক, দুই, তিন করে তাঁর ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও। ভারতের মধ্যে এখন অর্কিড সরবরাহে তাঁর স্থান এক নম্বরে।

 

 

কিন্তু কীভাবে গড়ে উঠল অর্কিডের সঙ্গে তাঁর এই সখ্যতা ? বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে কালিম্পং ভ্রমণে গিয়েছিলেন রুমকিদেবী। সেই পাহাড় ভ্রমণের ফাঁকেই অর্কিডের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, প্রেম মায় মধুচন্দ্রিমাও হয়ে যায় রুমকিদেবীর। ফেরার সময় কয়েকটি অর্কিডের চারা নিয়ে আসেন বাড়িতে। বাড়ির ছাদে শুরু করেন চাষ। ফুল ফোটার পর ছবি তুলে পোষ্ট করেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে। ফেসবুকের বন্ধুরা ছবি দেখে তারিফ তো করেনই, কেউ কেউ আবদার করে বসেন তাঁদের ওই অর্কিড চারা পাঠানোর জন্য। ব্যস। এভাবেই শুরু। প্রথম দিকে কার্সিয়াং, কালিম্পং থেকেই চারা এনে চাষ করতেন এবং তা বিক্রি করতেন পরিচিত বন্ধুদের কাছে। ধীরে চাহিদা বাড়তে থাকায় বুঝতে পারেন অর্কিডের ভাল বাজার রয়েছে দেশের মেট্রো শহরগুলোর পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও। স্বামী মৃণালের সঙ্গে পরামর্শ করে বাড়ির ছাদে বানিয়ে ফেলেন আস্ত দুটি গ্রিনহাউস। নেট সার্চ করে স্বামী-স্ত্রী মিলে রীতিমতো পড়াশোনা শুরু করেন অর্কিড নিয়ে। এভাবেই পেয়ে যান থাইল্যাণ্ড ও তাইওয়ানে নানা প্রজাতির দুর্লভ অর্কিডের সন্ধান। স্বামীর সহযোগিতায় নিজের নামে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের লাইসেন্স সহ বানিয়ে ফেলেন একটি ওয়েবসাইটও। শুরু হয় থাইল্যাণ্ড ও তাইওয়ান থেকে বিভিন্ন অর্কিড চারার আমদানি।

রুমকি দেবী জানালেন, তিনি মূলত উষ্ণ এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় যে অর্কিড জন্মায় তার চাষই করছেন। এখন তাঁর বাড়ির ছাদে ওয়ার্ম গ্রোয়িং ও ইন্টার মিডিয়াম গ্রোয়িং — এই দুই শ্রেণীর মিলিয়ে মোট প্রায় হাজার রকমের অর্কিড চাষ করছেন তিনি। যাঁদের কাছ থেকে চারা কেনেন, মূলত তাঁদের সঙ্গে কথা বলেই এবং নেট ঘেঁটে রপ্ত করেছেন চাষের পদ্ধতি। নিজেই জানালেন, চাষের পদ্ধতি খুব একটা জটিল নয়। নতুন চারা এনে লাগানোর পর একবার ওষুধ প্রয়োগ করলেই নিশ্চিন্ত। শীতকালে দুইদিন অন্তর ও গ্রীষ্মকালে দিনে দুইবার জল সিঞ্চন করলেই যথেষ্ট।
কী কী অর্কিড রয়েছে ? জিজ্ঞেস করতেই গড়গড় করে একের পর এক নাম বলে যান রুমকিদেবী। ডেনড্রোবিয়াম, ফেলোনপসিস, ভ্যানিলা, ঝুলন্ত ভ্যাণ্ডা, লেডিস স্লিপার, ক্যাটাসিটাম, অনসিডিয়াম — আরও কত নাম যে শোনালেন !
কথায় কথায় জানালেন, দেশের মধ্যে অর্কিডের বাজার মূলত মেট্রো ও বড় শহরগুলিতে। দুর্লভ অর্কিডের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। তার দামও বেশি। যেমন ডেন্ড্রোবিয়াম ফার্মেরি পেটালয়েড আলভা নামের একটি দুর্লভ অর্কিড চারার দামই ভারতীয় মুদ্রায় ৯ হাজার টাকা। অন্যান্য চারার মূল্য প্রতি পিসে ২ থেকে ৬ হাজার টাকা। অকপটে জানালেন, অনলাইনে প্রতি মাসে দুর্লভ ও সাধারণ শ্রেণীর অর্কিডের জন্য গড়ে প্রায় ১০০ টি অর্ডার আসে। অর্ডার এলেই চাহিদা মতো অর্কিড চারা ছাদ থেকে সংগ্রহ করে নিজে হাতেই প্যাকিং করে ছোটেন পোষ্ট অফিস কিংবা ক্যুরিয়ার সেন্টারে। দেশের মধ্যে দিল্লী, কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ সহ বিভিন্ন শহরে ধনীদের ঘর সাজাচ্ছে রুমকিদেবীর নানা প্রজাতির অর্কিড। অনলাইন ট্রেডিংয়ের হাত ধরে বিদেশেও অর্কিডের ব্যবসা ছড়িয়েছেন রুমকিদেবী। ইতিমধ্যেই ফ্রান্স, ইতালি ও থাইল্যাণ্ডেও গিয়েছে তাঁর বাড়ির ছাদের অর্কিড।

 

 

অসমের কাজিরাঙা ন্যাশনাল পার্ক থেকে শুরু করে আন্দামান নিকোবর দীপপুঞ্জের বিভিন্ন সরকারি অর্কিডেরিয়াম ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে,
ত্রিবান্দ্রমের সরকারি জহরলাল নেহেরু ট্রপিক্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন এণ্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে এবং
হরিয়ানা সরকারের হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্টও অর্কিড সংগ্রহ করে রুমকিদেবীর কাছ থেকে। শুধু কি তাই ? মুম্বাইয়ের বাল ঠাকরের পরিবার থেকে শুরু করে অরুণাচলের মন্ত্রীর ঘর সহ তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বের ঘরেও শোভা পাচ্ছে রুমকি দেবীর অর্কিড।
ছাদের গ্রিনহাউসে গাছের পরিচর্যা করতে করতেই বললেন, “প্রথম নিজের ঘর সাজাবো বলেই কয়েকটি অর্কিড নিয়ে আসি কালিংপঙ থেকে। তারপর এর প্রেমে পড়ে যাই। কোনওদিন ভাবিনি, স্রেফ এই সখের প্রেম ও নেশা এভাবে ব্যবসায় পরিণত হবে। একান্ত ভালবাসার অর্কিড আমার ঘরে শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেনি, লক্ষ্মীও এনে দিয়েছে। তাই আমার অর্কিড প্রেম আরও গভীর হয়েছে।”

Related News

Back to top button