Archiveপোর্টজিন

মা ভাষা মাসে দিনাজপুরে এসে -সুকুমার বাড়ই

 

Nblive বাংলাদেশঃ  আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…। তার ডাক উপেক্ষা করতে পারি ? কয়েকজন সহৃদয় বন্ধুর আমন্ত্রণ পেয়ে তাই বেরিয়েই পড়লাম। ট্রেনে চেপে সোজা রাধিকাপুর। অপার আনন্দে তরঙ্গ বইছে আমার ভিতর ও বাহিরে। বাড়ি থেকে স্টেশনে যাওয়ার সময়, ট্রেনে চলতে চলতে অনেকেই প্রশ্ন ছুড়েছেন, “কোথায় চললেন ?” মুখে বলেছি, বাংলাদেশ। মন বলেছে, শিকড়ের খোঁজে। প্রাণ ভরে দেখব আমার সোনার বাংলা। চোখ জুড়াবো সবুজ ধানের খেতে বাতাস কেমন ঢেউ খেলে যায় দেখে।

ভারতীয় কাস্টমস ও পাসপোর্ট অফিসের কাজ সেরে এগোলাম জিরো পয়েন্ট-এর দিকে। বি এস এফ চেকিং করিয়ে এদেশের সীমানা পার হলাম। ওপারে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন দিনাজপুরের দুই বিশিষ্ট মানব হৃদয়। প্রাক্তন ব্যাংক আধিকারিক সফিকুল বাবলু ভাই এবং প্রাক্তন কলেজ অধ্যক্ষ সইফুদ্দিন আখতার।

 

এই দুজন বিডিআর চেকপোস্ট থেকেই আমাকে আতিথেয়তার কোমল বাঁধনে বেঁধে ফেললেন। চার্জার মানে আমাদের দেশের টোটো রেডি ছিল। এপারের সীমান্তবর্তী স্টেশন বিরল। সেখানেই বাংলাদেশ কাস্টমস ও পাসপোর্ট অফিসের কাজ সেরে রওনা দিলাম দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় পড়ল পাকুরিয়া। নেমে পড়লাম টোটো থেকে। সেখানে সইফুদ্দিন ভাইয়ের এক ছাত্রের সৌজ্যনে চা পান।

চার্জার ছুটছে দিনাজপুরের দিকে। আমার সোনার বাংলা দেখতে দেখতে আর সঙ্গী দুইজনের মুখে দিনাজপুরের কাহিনী শুনতে শুনতে কখন যে গন্তব্যে পৌঁছে গেছি বুঝতেও পারিনি। বেলা তখন দ্বিপ্রহর। দিনাজপুর বেশ বড় শহর। দেখেই বোঝা যায় খুব বনেদি ও পুরনো। পরিচয় হল হোসেন সৈয়দ হাসানুজ্জামান ও নাট্যজন সনৎ চক্রবর্তীর সাথে।

হাতে সময় কম। তাই আবার একপ্রস্থ চা পান করেই বেরিয়ে পড়লাম। এবার আমার গাইড অ্যাণ্ড ফিলোসফার হলেন দুই বন্ধু হাসানুজ্জামান ও সনৎ চক্রবর্তী। হাজির হলাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। কর্ণধার মিনআরা পারভিনের কাছ থেকে সংস্থার কাজ ও “আমাদের থিয়েটার”-এর গল্প শুনলাম।

 

এবার গন্তব্য ইটে গাঁথা মহাকাব্য কান্তজীউর মন্দির। এই মন্দির উপমহাদেশের স্থাপত্যের একটি অপূর্ব নিদর্শন। দিনাজপুরের জমিদার প্রাণনাথ ও রামনাথ এই মন্দির নির্মাণ করেন। রাস্তায় চলতে চলতে দুধারে চোখে পড়ল ধান ও পাট গবেষণা কেন্দ্র, চেহেল গাজী শিক্ষা নিকেতন, দিনাজপুর সরকারি কলেজ, আঞ্চলিক ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হাজী মহ:গাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চেহেল গাজী মাজার শরীফ, সেকেন্ডারি বোর্ড-এর আঞ্চলিক কেন্দ্র… আরও কত কিছু।

বিকেলে গেলাম দিনাজপুর রাজবাড়ি। মূল বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে মহারাজাদের কীর্তি কাহিনী সারা দিনাজপুর জুড়ে এখনও ভেসে বেড়ায়। তাদের এই বাড়ি সংস্কার করে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা যেতেই পারে। দুটি পুরনো স্কুল জুবিলি স্কুল ও গিরিজানাথ হাই স্কুল দেখলাম। গিরিজানাথ স্কুলে চোখে পড়ল বীর মুক্তি যোদ্ধাদের স্মৃতি ফলক। ১৯৭২ সালের ৬ই জানুয়ারি মাইন বিস্ফোরণে নিহত ও আহত মুক্তি যোদ্ধাদের যেভাবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্মান জানিয়েছে তা সত্যিই দৃষ্টান্ত।

এরপর গন্তব্য রামসাগর। শহর থেকে একটু দূরে। মনোরম জায়গা। দিঘীর চারপাশে অরণ্য। ডিয়ার পার্কের হরিনগুলি আমাদের দেওয়া বাদাম খেল অনাবিল আনন্দে। দিনের শেষে দিনাজপুরে ফিরে এসে স্থানীয় কতিপয় বুদ্ধিজীবীর সাথে চলল আড্ডা। রাতে বাবলু ভাই এর বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে পারি দিলাম ঢাকা। দিনাজপুরের সকলের আন্তরিকতা সারাজীবন মনে থাকবে।

দিনাজপুর ঘুরে মনে হল এখানে বেশ কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এখানকার মানুষ উদার, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান মনস্ক। সাম্প্রদায়িকতার কালো ছায়া পড়েনি এখানকার মানুষের মনে। সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের পারস্পারিক সহাবস্থান। সব মিলিয়ে মন ভাল করা এক শান্ত সুন্দর শহর এই দিনাজপুর। একবার এলে এ শহরকে আলবিদা করা খুব কষ্টকর। যাবার বেলায় মন-বেহালায় সুর তুলবেন জীবনানন্দ– “আবার আসিব ফিরে… এই বাংলায়।”

ঢাকা সফরের বর্ণনা পরবর্তী পর্বে।

Related News

Back to top button