Archiveবিনোদন

রণবীর সিং থেকে আলাউদ্দিন খিলজি, কঠিন যাত্রাপথের গল্প

Nblive. অপরাজিতা জোয়ারদারঃ সঞ্জয়লীলা বনসালীর “পদ্মাবত” মুক্তির আগে থেকেই প্রশংসিত হয়ে আসছেন ছবির তথাকথিত ভিলেন বা নেগেটিভ ক্যারেকটার আলাউদ্দিন খিলজি চরিত্রের অভিনেতা রণবীর সিং। প্রোমোতে রাজা রতন সিং (শাহিদ কাপুর)-এর সংলাপ বা রানী পদ্মাবতী( দীপিকা পাডুকোন)-এর লুক আলোচ্য হলেও কোনো সংলাপ না বলেই শুধুমাত্র অভিনয় ও মুখের অভিব্যক্তির মাধ্যমেই তিনি জানান দিয়েছেন যে ছবির কেন্দ্রবিন্দু আলাউদ্দিন খিলজিই(রণবীর সিং)। নিজের অভিনয় দক্ষতায় আলাউদ্দিন খিলজির চরিত্র এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি যা মানুষের মনে দাগ কাটে।

 

ছবিতে প্রকৃত অর্থে ‘ভিলেন’ তিনি। প্রোমোতে কোনো সংলাপ ছাড়াই ভয়ঙ্কর আবহ তৈরি করা ও মানুষের মনে সেই ভয় অনুভূত করানো – এটা হয়তো শুধুমাত্র রণবীর সিং এর পক্ষেই সম্ভব ছিল। ট্রেলার মুক্তি পেতেই রণবীর সিংকে দেখে সকলের এটাই মনে হয়েছে যে এই ছবির মাধ্যমে তিনি তার ক্যারিয়ার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন। মাত্র ১০টি ছবি পুরোনো তার ক্যারিয়ার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে খিলজির মত নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিল বৈকি ! তবে জানা যায়, এমন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অফার পেয়েও কিন্তু প্রথম অবস্থায় নাপসন্দ ছিল রণবীরের।

কীভাবে এই অ্যান্টি হিরোর চরিত্রে তিনি অভিনয় করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু পরিচালক সঞ্জয়লীলা বনসালীকেও না বলতে পারতেন না তিনি। অবশেষে এই চরিত্রে অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সঞ্জয়লীলা বনসালীও রণবীর সিং-এর ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। আলাউদ্দিন খিলজির চরিত্রকে নিজের মত করে অভিনয়ের স্বাধীনতা ছিল রণবীরের। কিন্তু কোনো দৃশ্যে পারফেক্ট এক্সপ্রেশন না দিতে পারলে রীতিমতো কাঁদতেন রণবীর। আর কিছুটা সময় একা থেকে চরিত্রকে আরও বেশি আবেগ দিয়ে অভিনয় করতেন তিনি। আলাউদ্দিন খিলজিকে রুপোলী পর্দায় নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে তিনি চরিত্রে এত বেশি প্রবেশ করে ফেলেছিলেন যে ডিপ্রেশনে চলে গেছিলেন তিনি।

 

পরে এই চরিত্রের নেগেটিভিটি থেকে বেরোতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হয়েছিলো তাকে। ছবির স্যুটিং এর জন্য প্রায় এক বছর ধরে এই লুক -এ ছিলেন রণবীর। সম্প্রতি শেষবারের মত স্যোশাল মিডিয়ায় নিজের ছবি পোষ্ট করে এই লুককে বিদায় জানান তিনি। এই ছবির ক্লাইম্যাক্স স্যুট করতে মাথায় গুরুতর আঘাত পান রণবীর। কিন্তু তিনি অভিনয়ে এত বেশি মেতে ছিলেন যে পরিচালকের কাট না বলা পর্যন্ত তিনি বুঝতেই পারেননি যে, তার মাথা ফেটে গেছে। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় ও বেশ কয়েকটি সেলাই পড়ে। কিন্তু এর পরেও তিনি ফিরে এসে স্যুটিং শেষ করেন। এতে করে ভীষণ ইমপ্রেসড হয় গোটা ফিল্ম ইউনিট। প্রকৃত অভিনয় প্রেম হয়তো একেই বলে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তিন খানের পর কোনো হিরোকে যদি ছবি হিট হওয়ার গ্যারান্টি হিসেবে ধরা হয়, তাহলে সেটি রণবীর সিং। কিন্তু কিভাবে তিনি বলিউডে এই জায়গায় এলেন – চলুন জেনে নেই।

১৯৮৫ সালে মুম্বাই এর এক সিন্ধি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রণবীর সিং ভাবনানী। ছোটোবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি টান ছিল তাঁর। শাহরুখ খান, সলমন খান যেখানে থাকতেন সেই এলাকাতেই বেড়ে উঠেছেন রণবীর। বলিউডে এসে রণবীর কাপুরের সাথে নাম উল্টোপাল্টা হওয়ার ভয়ে নিজের নাম পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন তিনি। অনেকেই হয়তো জানেন না রণবীর সিং অভিনেত্রী সোনাম কাপুরের মাসতুতো ভাই। রণবীর সিং মুম্বাই এর এইচ আর কলেজে পড়াশুনা করেন। সেসময় তার সবচাইতে কাছের বান্ধবী ছিলেন ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনীর মেয়ে আহানা দেওল। তাদের বন্ধুত্ব এতটাই গভীর ছিল যে তাদেরকে কাপল হিসেবেই জানতেন সকলে। যদিও এই সম্পর্ক এগোয়নি। কিন্তু আহানা আজও রণবীরের বান্ধবী, এমনকি আহানার বিয়েতেও গেছিলেন রণবীর। মুম্বাই এর পড়া শেষে রণবীর সিং আমেরিকার ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে অভিনয় ও থিয়েটারের ট্রেনিং নিতে যান।

ফিরে এসে বলিউডে নিজের পা রাখার সংঘর্ষ শুরু হয় তার জীবনে। এই সংঘর্ষ এতটাই দীর্ঘ হয়ে পড়লো যে অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সি ও এন এম সংস্থায় ক্রিয়েটিভ রাইটার হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন। এই সময় বিভিন্ন অ্যাডভারটাইজমেন্টে ও ভিডিও অ্যালবামে অভিনয়ের অফার আসে রণবীরের। কিন্তু তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, ক্যামেরার সামনে এলে তিনি হিরো হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করবেন, নয়তো কিছুই করবেন না। নির্দশক শাহদ আলির সাথেও কাজ করতে হয়েছে তাকে। সেই সময়ে শরীরের প্রতি যত্ন না করতে পেরে ওজনও বেশ বেড়ে গেছিলো তার। এরপর অভিনেতা হওয়ার লক্ষ্যে মুম্বাই এর একটি অ্যাক্টিং স্কুলে ভর্তি হন তিনি। কিন্ত হিরো হওয়ার অফার তখনও পাননি তিনি। এরপর পৃথ্বী থিয়েটারে যোগ দেন তিনি। এখানে সকলের জন্য সিঙ্গারা আনা থেকে সাফাই সবই করেছেন তিনি। যদিও সিঙ্গারা আনার সময় রণবীর ভাবেনইনি যে, খুব শীঘ্রই ‘ব্রেড পাকোড়া’ খেতে হবে তাকে। হ্যা, প্রথম ছবি ” ব্যন্ড বাজা বারাত ” এ বিট্টু (রণবীর সিং) কে ব্রেড পাকোড়া খেয়ে বলতে হয়েছিলো ছবির কিছু বিখ্যাত সংলাপ। যদিও এর আগে তিনটি ছবির অফার নাকচ করেছিলেন তিনি। কারন রণবীর তার ডেবিউ কোনো বড় ব্যানারে করতে চেয়েছিলেন।

যশরাজ ব্যনারে অডিশন দিতে কাস্টিং ডিরেক্টর সানু শর্মার ডাক পাওয়ার সময় কারো সাথে ডেটিং এ ব্যস্ত ছিলেন রণবীর। যার জন্য না বুঝে এই গুরুত্বপূর্ণ ফোন রিসিভই করেন নি তিনি। এই ছবিও তার হাত থেকে ফস্কে যেতে বসেছিলো। যদিও পরে কোনো মতে খবর দেওয়া হয় তাকে। এরপর স্টুডিওতে অডিশন দিতে এলে আদিত্য চোপড়া তাকে দেখামাত্র ছবির নায়কের চরিত্রে অভিনয় করানোর জন্য নির্বাচন করেন। যশরাজ ফিল্মস এ বহু বছর পর নতুন মুখকে নায়ক হিসেবে চঞ্চ করা হয়। ছবিও সফল হয়। কিন্তু ছবির স্যুট চলাকালীন শুধু নয় ছবির কাজ শেষ হওয়ার পরও গুজব রটে যে এই ছবিতে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য রণবীরের বাবা টাকা দিয়েছিলেন। এই গুজব তাকে মানসিকভারে কষ্ট দেয়।

কারন এই জায়গায় আসার জন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি রণবীরকে। যদিও এইসব রটনাকে পাশ কাটিয়ে রণবীর বেস্ট ডেবিউ অ্যাক্টরের অ্যাওয়ার্ড পান। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি রণবীরকে। বর্তমানে তিনি বলিউডের সফল নায়কদের মধ্যে একজন। পারিবারিক দিক থেকেও রণবীর সিং ভীষণ আবেগপ্রবণ। ছোটোবেলা থেকেই ‘মাম্মা’জ বয়’ ছিলেন তিনি। তার বোন ঋত্বিকাকেও খুবই ভালোবাসেন তিনি। ঋত্বিকার বাধা রাখী সম্পূর্ণ না ভাঙা পর্যন্ত হাতেই পড়ে থাকেন তিনি। একাধিকবার প্রেমেও পড়েছেন রণবীর। তার কো-স্টার দের সাথেও নাম জড়িয়েছে বহুবার। প্রথম ছবির নায়িকা অনুষ্কা শর্মার সাথে রনবীরের সম্পর্ক বহুচর্চিত হয়েছে। যদিও অনুষ্কা শর্মার সাথে তার সম্পর্ক কোনো রূপ পায়নি। তারা এখনও ভালো বন্ধু ও বিভিন্ন ছবিতে একসাথে কাজও করেছেন। সঞ্জয়লীলা বন্সালী পরিচালিত “রামলীলা ” ছবির স্যুট চলা থেকেই রণবীর সিং ও দিপীকা পাডুকোনের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। এই সম্পর্ক প্রেমে পরিণত হয় শীঘ্রই।

২০১৬ সালে আইফা অ্যাওয়ার্ডস এর সেটে সর্বসমক্ষে দিপীকাকে প্রেম নিবেদনও করেন রণবীর। জনপ্রিয় একটি টক-শো তে রণবীর সিং কে বৈবাহিক জীবনের ও সুস্থ্য সন্তানলাভের শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন দিপীকা পাডুকোনের প্রাক্তন প্রেমিক রণবীর কাপুর। সম্প্রতি রণবীর সিং ও দিপীকা পাডুকোনের এনগেজমেন্টেরও খবর ছড়িয়ে পড়ে। খ্যাতির শিখরের পথে রণবীর সিংকে তার অভিনিত “বাজিরাও মস্তানি ” ছবির অভিনয়ের প্রশংসায় নিজে হাতে চিঠি লেখেন বিগ বি অমিতাভ বচ্চনও। যা খুবই সম্মানের রণবীরের কাছে। এই ছবির জন্য বেস্ট অ্যাক্টর হিসেবে ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। অভিনয় ছাড়াও র‍্যাপ সং এও তিনি পারদর্শী। “লেডিস ভার্সেস রিকি বেহল “ছবির একটি গানে র‍্যাপিং নিজেই করেছেন তিনি। এমনকি অন্যান্য অভিনেতা দের ছবি ছবির প্রোমোশন করতেও নানা ধরনের ভিডিও বানিয়ে আপলোড করেন তিনি। নিজেকে ফিট রাখার জন্য ডায়েট কড়া ভাবে মেনটেইন করেন রনবীর সিং।

 

কার্বোহাইড্রেট একেবারেই নয়, নিজের ডায়াটে প্রোটিন রাখেন রণবীর। “পদ্মাবত” এর আলাউদ্দিন খিলজি চরিত্র রণবীরের অভিনয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। সকলের আশা এই মাইলস্টোন পেড়িয়ে রণবীর সিং প্রতিবার খ্যাতির শিখরে পৌঁছক।

Related News

Back to top button