Archiveবেঙ্গল লাইভ Special

লজ্জা, আতঙ্ক, প্রহসন মেশা ২০১৭, ফিরে দেখা উত্তর দিনাজপুর

 

Nblive রায়গঞ্জঃ সালটা ২০১৭। কথায় আছে “সতরা মতলব খতরা”। প্রবাদ বাক্যটি যে ভুল নয় তা প্রমাণ করেছে ২০১৭।  বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, কখনও চিতার হামলা আবার কখনও বোমা গুলি হাতে শহরের বুকে দুষ্কৃতীদের তান্ডব। শহরের বাসিন্দাদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে একাধিকবার। একদিকে আদিবাসী বিপ্লব অন্যদিকে ভয়াবহ বন্যা। রায়গঞ্জ নামটার সাথে জড়িয়ে যাওয়া কলঙ্ক ধুতে গিয়েই যে বন্যা কেড়ে নিয়েছে মানুষের ছাদ ও প্রাণ! তবু কি মুছে গিয়েছে ৯ জুলাইয়ের সেই কলঙ্ক? জানা নেই কারোর। ভয়, আতঙ্ক, লজ্জার গল্পে ইতি টেনেছে রায়গঞ্জের প্রাক্তন সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মৃত্যু। সব মিলিয়ে ফিরে দেখা একগুচ্ছ গল্পের ২০১৭।

আতঙ্কঃ

ঘড়িতে তখন সকাল সাতটা। ঘরের পাশে ভয়ঙ্কর গর্জনে ঘুম ভাঙে রায়গঞ্জের ইন্দিরা কলোনীর বাসিন্দা নতুন পোদ্দারের। শীতের সকালে বন্ধ ঘরেও এমন ভয়ঙ্কর গর্জনের উৎস খুঁজতে জানালা খুলতেই আস্ত চিতার দর্শন করেন তিনি।
শুরু হয় আতঙ্কের চিৎকার- “বাঘ”। ছুটে আসেন আশপাশের সকলে। ডুয়ার্সের জঙ্গল থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রায়গঞ্জে বাঘ দেখতে পেয়ে
মানুষ যেমন আতঙ্কিত তেমনি মানুষের চিৎকারে ভয় পেয়ে যায় চিতাবাঘটিও। নিজের জীবন সংকটে পড়েছে বুঝে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি, এক কলা বাগান থেকে গৃহস্থের ঘরে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টায় দিশাহারা চিতাটি। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে পশুপ্রেমী সংগঠন ‘পিপল ফর অ্যানিমালস’-এর সদস্যরা। প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে মাছ ধরার জাল দিয়ে বাঘটিকে কব্জা করার চেষ্টা করতে গিয়ে চিতার থাবায় জখম হন চারজন সদস্য। হাতের মাংস খুবলে নেয় রাজেন শর্মা  নামে এক স্বেচ্ছা সেবকের। অবশেষে দিনভর বাঘবন্দি খেলার অবসান ঘটায় চিতাটি নিজেই। নিজের প্রাণ বাঁচাতে বিপ্লব সাহার বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে নিজেকে বন্দি করে ফেলে সে। শেষমেশ চিতাকে খাঁচা বন্দি করতে এক্সপার্ট বনকর্মীরা এসে ঘুমপাড়ানি ইঞ্জেকশন ছুঁড়ে বাগে আনেন চিতাটিকে। ঘুমন্ত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় সুকনায়। তবে হঠাৎ বাঘের আগমন ঘটল কী করে সেই বিষয়ে এখনও কোনও খোঁজ পায়নি বন দফতর।

প্রহসনঃ

২০১৭ সালের ১৪ মে  ছিল রায়গঞ্জ পুরসভার ভোট গ্রহণের দিন। পুরভোটের আগেই রাজনৈতিক বেশ কিছু পালাবদলের জেরে পুরভোট যে শান্তি ও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবে না, সেই বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন প্রত্যেকেই। প্রত্যাশা মতোই সেদিন সকাল থেকে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে ভোট প্রক্রিয়া শুরু হতেই আচমকা রায়গঞ্জ করোনেশন হাইস্কুলের বাইরে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ রণক্ষেত্রের চেহারা ধারণ করে। আগ্নেয়াস্ত্র সহ গ্রেফতার হয় এক দুষ্কৃতী। এরপরেই যেন একঝাঁক বহিরাগত দুষ্কৃতীদের দখলে চলে আসে শহরের ২৬টি ওয়ার্ড। বোমা গুলির আওয়াজে কাঁপতে শুরু করে রায়গঞ্জের মাটি।

বিভিন্ন ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের দখল নিতে শুরু করে দুষ্কৃতীরা। পুলিশের সামনেই বোমা ও গুলি চালিয়ে প্রার্থী ও ভোট দিতে আসা শহরের নিরীহ মানুষদের তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। একাধিক বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ তোলেন বিরোধীরা। ভোট চলাকালীনই দুষ্কৃতীদের তান্ডবে নিজের ওয়ার্ড ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন প্রাক্তন পুরপতি মোহিত সেনগুপ্ত। বাম কংগ্রেস মিলিত ভাবে ভোট বয়কটের ডাক দিলেও লড়াইয়ের ময়দান তখনও ছাড়েনি বিজেপি। অবশেষে প্রহসনের ভোটের বিরুদ্ধে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বিজেপি কর্মী সমর্থকেরা। পুলিশকে উদ্দেশ্য করে থু থু ছিটিয়ে বিক্ষোভ দেখান বিজেপির মহিলা মোর্চার সদস্যরা। রায়গঞ্জ পুরভোটে দুষ্কৃতীদের এমন তান্ডব চাক্ষুষ করে হতভম্ব শহরের বাসিন্দারা। এমন আতঙ্কের ভোট আগে কখনও দেখেননি কেউ বলেই জানিয়েছিলেন সকলে।

লজ্জাঃ

দিনটা ছিল ৯ জুলাই। চোপড়ায় দুষ্কৃতীদের ছোঁড়া গুলিতে বিজেপির এক কর্মীর মৃত্যুর প্রতিবাদে জেলা জুড়ে চলছে ধর্মঘট।  বন্ধ রয়েছে বেসরকারি যানচলাচল। জনশূন্য শহরের রাস্তাঘাট। ফাঁকা রায়গঞ্জ পুরবাস স্ট্যান্ড। এমন পরিস্থিতিতে চার আদিবাসী মহিলাকে শ্লীলতাহানি করার অভিযোগ উঠল কয়েকজন দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে। ঘটনায় মূল অভিযুক্তদের তড়িঘড়ি গ্রেফতার করলেও আদিবাসী মহিলাদের উপর বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে ১৪ জুলাই পথে নামে পাঁচটি আদিবাসী সংগঠনের প্রায় দশ হাজার মানুষ। শুরুটা শান্তিপূর্ণ ভাবে হলেও আদিবাসীদের সশস্ত্র মিছিল রায়গঞ্জ পুরবাস স্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছতেই রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে বাসস্ট্যান্ড চত্বর। ভাঙচুর চালানো হয় পুরবাস স্ট্যান্ড ভবনে। আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আইএনটিটিইউসির জেলা কার্যালয়ে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সাইকেল, মোটর বাইক, চারচাকা গাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ ঘটানোর অভিযোগ ওঠে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে।

যথেষ্ট পুলিশ শহরে না নামানোর জেরে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় শহরজুড়ে। আদিবাসীদের ছোঁড়া তির থেকে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে দোকান পাট বন্ধ করে দেয় শহরের ব্যবসায়ীরা। রাতভর শহরের বিভিন্ন রাস্তায় চলে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ। কয়েকলক্ষ টাকার ক্ষতির মুখে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের। আদিবাসী বিপ্লবকে ঘিরে এমন আতঙ্কের পরিবেশে ১৫ জুলাই অঘোষিত বন্ধের চেহারা নেয় শহর রায়গঞ্জ।

ক্ষতিঃ

১৪ অগষ্ট সকাল, পাহাড়ে লাগাতার ভারি বর্ষণের জেরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে উত্তরবঙ্গের নদীগুলি। তিস্তা, তোর্ষা, মহানন্দার মতন উত্তরবঙ্গের নদীগুলি তখন বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। এদিকে উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর মহকুমা এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন জলমগ্ন। বন্যার জল ইতিমধ্যেই গ্রাস করেছে করণদিঘি,ইসলামপুর, চোপড়ার বহু গ্রাম। ঘর-বাড়ি ছাড়া তখন জেলার কয়েক হাজার মানুষ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, কুলিকের জল ফুলে তখন বাঁধের সমান সমানে বইছে। নদী সংলগ্ন রায়গঞ্জ পুর এলাকার বাসিন্দাদের আশঙ্কা, রাতের মধ্যেই বাঁধে ফাটল ধরতে পারে। তাই সন্ধ্যা নামতেই শুরু ঘর-বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার পালা।  শক্তিনগর সহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা তখন ছুটছেন নিজেদের সম্পত্তি রক্ষার শেষ পর্যায়ের লড়াইতে। শেষ পর্যন্ত বাসিন্দাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো।  রাত পেরোনোর আগেই বাঁধের একাধিক জায়গায় ফাটল ধরার কারণে জল ঢুকতে শুরু করল শহরে। স্বাধীনতা দিবসের সকালেই শহরের প্রায় ১০ টি ওয়ার্ড কুলিকের জলে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। শহর সংলগ্ন ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে প্রবল বেগে জল বয়ে চলার কারণে বিপর্যস্ত যান চলাচলও। জলের স্রোতে ক্ষতির মুখে পড়ে রেল লাইনও। বন্ধ হয়ে যায় উত্তর-পূর্বের সাথে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা।
এদিকে বিকেলের মধ্যেই কুলিকের বাঁধ বেশ কয়েকটি জায়গায় ভেঙে যায়, ফলে শহরের পাশাপাশি ভাসতে শুরু করে গ্রামও।  জলমগ্ন হয়ে পড়ে ইটাহার ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভয়াবহ বন্যায় জেলাজুড়ে প্রাণহানির পাশাপাশি কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয় ফসলেও। তবে বন্যা দুর্গতদের হাতে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছতে প্রশাসন ব্যর্থ হলেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের একক প্রচেষ্টা এক নতুন নজির সৃষ্টি করে। দুর্গতদের হাতে খাবার তুলে দিতে পথে নামে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

নক্ষত্র পতনঃ

প্রায় নয় বছর দিল্লির অ্যাপেলোর ২৬০৫ নম্বর জনশূন্য কেবিনে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০ নভেম্বর পরলোক গমন করেন দেশের সংসদীয় রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। ১৯৯৯ ও ২০০৪ সালের পরপর দুইবার রায়গঞ্জ কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে সাংসদ ও পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। এরপর ২০০৮ সালের ৭ জুলাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন  প্রিয়বাবু। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী  মনমোহন সিং-এর উদ্যোগে তড়িঘড়ি তাঁকে বিশেষ বিমানে দিল্লির এইমস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মস্তিষ্কে মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তাঁর বাহ্যিক চেতনা লোপ পায়। বেশ কয়েকমাস সেখানেই চিকিৎসাধীন থাকার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু পরিবার ও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রিয়রঞ্জনকে দিল্লির অ্যাপেলো হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই থেকেই দীর্ঘ ৯ বছর ধরে অ্যাপেলোর ২৬০৫ নম্বর জনশূন্য কেবিনই ছিল প্রিয়বাবুর ঠিকানা। সেদিন সকালে দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর থেকেই শোকের ছায়া নেমে আসে দেশের রাজনৈতিক মহলে। প্রধানমন্ত্রী থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী টুইটারে শোকবার্তা জানান। প্রিয়বাবুর মৃত্যুকে বিরাট ক্ষতি বলে অভিহিত করেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি দফতরে অর্ধদিবস ছুটিও ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। এরপর ২১ নভেম্বর বিকেল নাগাদ হেলিকপ্টারে করে কলকাতা থেকে প্রিয় নেতার পার্থিব দেহ রায়গঞ্জে পৌঁছায়। নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণের ঢল নামে রায়গঞ্জ ও কালিয়াগঞ্জের রাস্তায়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রায়গঞ্জের বন্দর শ্মশানঘাটে সম্পন্ন হয় প্রিয় বাবুর শেষ কৃত্য।

Related News

Back to top button