Archiveপোর্টজিন

শরৎ আলোয় সামতাবেড় : কথা সাহিত্যের আঁতুড়ঘরই বিপ্লবীদের ডেরা — সুকুমার বাড়ই

 

Nblive পোর্টজিনঃ পারিবারিক প্রয়োজনে গিয়েছিলাম দেউলটি। দেউলটি ছোট্ট স্টেশন। কোলাঘাটের একটু আগে। স্টেশনের পাশেই নিরলা রেসর্ট। ওখানেই আমাদের থাকার জায়গা। জায়গাটা মনোরম। দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে বের হলাম আমার প্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের কুঠি দেখতে। যাঁর পথের দাবি, শ্রীকান্ত, মহেশ, রামের সুমতি পড়ে বড় হয়েছি, আমরা যাচ্ছি তাঁর বাড়িতে। মনে ভীষণ আনন্দ। একটা শিহরণও হচ্ছে।

হাওড়া জেলার পানিত্রাস এলাকার একটি গ্রাম। নাম সামতাবেড়। রূপনারায়ণ বয়ে যাচ্ছে গ্রামের কোল ঘেঁষে। প্রকৃতি যেন তার সৃষ্টির সমস্ত কৌশল এখানে প্রয়োগ করেছে। এখানেই জীবনের ১২ টি বছর কাটানোর জন্য আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সেই বারো বছরের বাড়ি ভিটে দেখতেই হিমের পরশ গায়ে মেখে পৌঁছে গেলাম সামতাবেড়।

 

বাড়ির সামনে একটি পুকুর। সংলগ্ন বাগানটিতে যেন সবুজের মেলা বসেছে। কেয়ার টেকার দুলাল মান্নার সৌজন্যে বাড়ির চারপাশ বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দুলাল বাবুর সাথেই কথা বলে জানা গেল এই বাড়ি তৈরির প্রেক্ষাপট। শরৎচন্দ্র তখন চাকরি সূত্রে বার্মায়। সেখানেই তাঁর প্রথম স্ত্রী ও পুত্র প্লেগ রোগে মারা গেলেন। তিনি ফিরে এলেন স্বদেশে। এর পর হাওড়ায় ভাড়া বাড়িতে কিছুদিন বসবাস। দিদি অনিলা দেবীর বিয়ে হয়েছিল কাছেই গোবিন্দপুরে। সামতাবেড় তাঁর নজর কাড়ে তখনই। ভীষণ পছন্দ হওয়ায় ১৯২৩ সালে এক খণ্ড জমি তিনি কিনে ফেলেন সেখানে। দুই বছরের মধ্যে, ১৯২৫ সালে বাড়িও তৈরি হয়ে যায়। পরের বছর, ১৯২৬ সাল থেকে শরৎচন্দ্র বসবাস শুরু করেন এই নতুন বাড়িতে। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এই বাড়িই ছিল তাঁর সাহিত্যচর্চা ও জীবন যাপনের ধাত্রীভূমি ।

[metaslider id=20560]

গেট পেরিয়ে বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকতেই সামনের বাগান যেন আমাদের আহ্বান করছে। ডান দিকের বাগানে নানা রঙের বাহারি ফুল। বাদিকে কথা সাহিত্যিকের সাদা আবক্ষ মূর্তি। বাড়ির ঠিক সামনে একটি শূন্য খাঁচা। কথাশিল্পীর পোষা ময়ূর নাকি থাকত সেই খাঁচায়। এরই মাঝে টালির চাল দেওয়া লাল-কালো রঙের বড়সড় একটা দোতলা বাড়ি। এই বাড়িতে বসেই শরৎচন্দ্র সৃষ্টি করেছেন তাঁর মরমী গল্প “অভাগীর স্বর্গ”। পাশের বাড়ির একটি গরুর করুণ পরিণতি দেখে এই কুঠিতে বসেই রচনা করেছিলেন মর্মস্পর্শী কাহিনী “মহেশ”। শুধু কি তাই ? আরও বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাসেরই আঁতুড়ঘর এই বাড়ি। “বামুনের মেয়ে”, “পল্লিসমাজ”, “রামের সুমতি”, “শ্রীকান্ত”-র চতুর্থ পর্ব লিখেছেন এখানে বসেই। এ বাড়িতে তাঁর শেষ লেখা উপন্যাস “বিপ্রদাস”।

ডান দিকে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি। বাপাশে ঘরের ভেতরে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। মূর্তিটি চিত্তরঞ্জন দাস শরৎবাবুকে দিয়েছিলেন। বাড়ির পেছনের দিকেও বাগান। এখানে ধানের মরাই ও একটি ছোট ঘর। বিভিন্ন আচার- অনুষ্ঠানে এটি ব্যবহৃত হয়। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম উপরে। ডান দিকের জানলায় উঁকি দিয়ে দেখলাম বাংলা সাহিত্যে নারী চরিত্রের আবেগ মোচরানো মানুষটির শোবার ঘর। বালিশ, বিছানা, অন্যান্য আসবাব সব পরিপাটি করেই গোছানো। একটু আগেই যেন তাঁর “মেজদি” এসে গুছিয়ে দিয়ে গেছেন। পাশের ঘরে তাঁর ব্যবহার করা বহু জিনিস। বই, লাঠি , জুতো, আলমারি, রেডিও, আলনা, টেবিল, গড়্গড়ী — দেখে মনে হল, যেন ঘরময় সাজানো লেখকের স্মৃতি জাগানিয়া মণি-মুক্তো। দোতলার ওপাশটায়, মানে রূপনারায়ণ নদীর দিকে খাঁচায় পোষা কিছু রঙবেরঙয়ের পাখি। একটি সুতো কাটার চরকা।
বাইরে তাকালে চোখে পড়ে সমাধি ক্ষেত্র। তিন জনের সমাধি। হিরণ্ময়ী দেবী (তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী), এক ভাই স্বামী বেদানন্দ মহারাজ ও স্বয়ং কথাশিল্পীর সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা।

ইতিহাস বলে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এই বাড়ি বিপ্লবীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলো। এই রকম একটি প্রান্তিক গ্রামে ইংরেজদের নজর ঠিকঠাক পৌঁছাতো না। নেতাজি, রাসবিহারী বসুর মতো দেশ বরেণ্য সংগ্রামীদের পায়ের ধূলিও মিশে আছে এ বাড়ির আনাচেকানাচে। তাঁদের অনেক বৈপ্লবিক কাজকর্মেরই সাক্ষী এই বাড়ি। রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের তত্বাবধানে থাকা এই ঐতিহাসিক বাড়ির দরজা জনগণের জন্য প্রতিদিনই খোলা থাকে। জেনে পুলকিত হলাম, বাগনান-২ ব্লকের এই গ্রাম যে পঞ্চায়েতের অন্তর্গত তার নামকরণ হয়েছে কথাশিল্পীর নামেই। শরৎচন্দ্র গ্রাম পঞ্চায়েত।

পুনশ্চঃ শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৭৬ এর ১৫ই সেপ্টেম্বর, হুগলী জেলার (ব্যান্ডেল এর কাছে) দেবানন্দপুরে । মৃত্যু ১৯৩৮ এর ১৬ই জানুয়ারী, কোলকাতাতে। দেবানন্দপুর ঘোরার বিবরণ পরের পর্বে লেখার ইচ্ছে রইলো ।

 

(লেখক ইটাহার ডঃ মেঘনাদ সাহা কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক)

Related News

Back to top button