অনুষ্কা শর্মার প্রযোজিত ছবিতে কেন ভূতেরা স্থান পায় না?
ভূত আদতে একজন পুরুষ। সে আসলে পুরুষতান্ত্রিক ভৌতিক সমাজব্যবস্থাকেই প্রতিষ্ঠা করে। লিখেছেন সৌমদীপ গুহ।
Bengal Live বিনোদনঃ
আদিঃ অনুষ্কা শর্মা-র নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে নানা ভাবে। ফলস্বরূপ সিনেমা প্রযোজনার শুরুতেই NH-10, তারপর একে একে ফিল্লৌরি, পরী এখন বুলবুল। সুপার ন্যাচারাল বিষয়কে মাথায় রেখে নারীবাদকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি বারবার নারীকেই এগিয়ে এনেছেন “চুড়েইল”-এর প্রতিভূ হিসেবে। তাই তাঁর প্রযোজিত সিনেমায় স্থান পায়নি “ভূত”। কারণ “ভূত” আদতে একজন “পুরুষ”। এবং তার দৃষ্টিভঙ্গিতে “ভূত”রাও পুরুষতান্ত্রিক ভৌতিক সমাজব্যবস্থাকেই প্রতিষ্ঠা করে। তাই তিনি সুপারন্যাচারাল-এও নারীবাদ কায়েমের পক্ষে। এমনটা করে বোধহয় কেউ ভাবেননি আগে। ইণ্ডাস্ট্রিতে “হরর” সিনেমা প্রচুর হয়েছে। সেখানে কখনও পুরুষ ভূত আবার কখনও মহিলা ভূত জায়গা করেছে গল্পের প্রয়োজনে। কিন্তু অনুষ্কা শর্মার হাতে যখন ক্ষমতা, অর্থাৎ ক্লিন স্লেট ফিল্মস তখন সেখানে তিনি পুরুষকে সেই চরিত্র দিতে নারাজ। তাই বারবার “চুড়েইল”-এর অবতারণা।
শুধু তাই নয়, নাম ভূমিকাতেও তারাই স্থান পায়। চূড়েইল-এর ভূমিকায় নিজেকে ন্যস্ত করে থাকলেও এবার নিজের জায়গা দিয়েছে তৃপ্তি ডিমরী-কে। পরিচালকের দায়িত্বে বহাল করেছেন অনভিতা দত্ত-কে। গল্প, চিত্রনাট্য, ডায়ালগগ লেখার পর সরাসরি পরিচালকের ভূমিকায় আসীন অনভিতা। নতুনকে পরিচালনার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি এখানেও নারীবাদকে প্রাধ্যান্য দেওয়া হয়েছে কিনা তা ঠিক করে বলা মুশকিল।
অনুষ্কা শর্মার ছবিতে টলিউডের তাঁর পছন্দের পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় আবারও। বুলবুল-এও তার আংশিক উপস্থিতি। সঙ্গে রাহুল বোস, যাঁকে ইদানীং খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। এছাড়াও বলিউডে ভাল সংযোগ স্থাপনকারী পাওলি দাম। এছাড়াও দেখতে পাওয়া যায় অভিনাশ তিওয়ারি-কে। চুরানব্বই মিনিটের এই সিনেমার প্রাপ্তিস্থান নেটফ্লিক্স।
মধ্যঃ সিনেমার টাইটেল ও ক্রেডিটস সাধারণত সবাই এড়িয়ে যায়। কিন্তু বুলবুল-এ তার উপায় নেই। পুরো টাইটেল ও ক্রেডিট দেখতে বাধ্য করে তার অপূর্ব গ্রাফিক্স। নীল ও লাল রঙের ব্যবহারে মায়াবী এই ডিজাইন শুরুতেই মুগ্ধ করে এমন কিছু দৃশ্য নিয়ে যা সিনেমার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
১৮৮০-র বাংলার প্রেক্ষাপটে বুলবুল-এর গল্পের রচনা। যেখানে গাছে চড়ায় পারদর্শী বিয়ের সাজে সজ্জিত পাঁচ বছরের বুলবুলকে ডেকে আনা হয় বিয়ের মন্ডপে বসবার জন্য। অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক প্রথার শিকার আরেকটি শিশু। তার পরের ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুরো গল্প ঝরঝর করে নিজেকে বয়ান করে। আনপ্রেডিক্টেবল-এর ধ্বজা উড়িয়ে ঠিক তাই তাই বলে আগামীতেও। সমবয়সী বুলবুলের দেওরের প্রতি তার আগ্রহ এবং তুলনামূলক অনেক বেশি বয়সী স্বামীর তার ওপর জমিদারী অত্যাচার। অতঃপর তার মধ্যে “সুপারন্যাচারাল” শক্তির প্রবেশে “চুড়েইল”-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে একে একে “পুরুষ” অত্যাচারীদের বিনাশ। পুরো গল্প জুড়ে প্রযোজক ও পরিচালক নারীদের ওপর শোষণ-এর তত্ত্ব ও তথ্যকে তুলে ধরতে বধ্যপরিকর থাকার কারণে বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে থাকে সুন্দর লোকেশন।
এই লোকেশনের সাথে চরিত্ররা সম্পৃক্তই হতে পারে না কখনো। শুধুমাত্র বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় আটকে যায় বুলবুল। পুরো গল্পে নির্দিষ্ট ধারণাকেই প্রকাশ করতে ব্যস্ত পরিচালকের অবহেলার শিকার হয় গল্পের চরিত্ররা। প্রতিটি দৃশ্য ও সংলাপে নারীর প্রতি বঞ্চনা, শোষণ, অবহেলা ও রিভার্স ডমিনেট দেখাতে দেখাতে ভুলেই যান চরিত্রের অন্যান্য অনেক কাজ থাকে। থাকে তার ডিটেইলস ও লেয়ার। হয়ত এমনটা না করলে প্রযোজক মান্যতা দেবেন না। অর্থাৎ আবারও সেই একপেশে প্রপাগান্ডা নির্ভর ভারতীয় সিনেমা। নারীবাদ, পুরুষবাদ এসব নিয়ে সিনেমা আর কতদিন! সভ্যতা এগোচ্ছে, এগোচ্ছে চিন্তা ভাবনা। অথচ এই সিনেমার বিষয়বস্তু সেই ক্লিশে। পুরুষেরা নারীদের অত্যাচারের কথা বলবে, নারীরা পুরুষদের শোষণের কথা তুলে ধরবে। সেই তু তু ম্যায় ম্যায়! সিনেমার জন্য কি ভাবা যায় না সিনেমা!
ভারতীয় সিনেমাকে কিভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়া যায় এইসব ভাবা যায় না! আঞ্চলিক স্তরেই গুমরে থাকবে ভারতীয় শিল্প! আপনাদের টাকা আছে, ক্ষমতা আছে মেধা খুঁজে বার করুন। আর যাদের মেধা রয়েছে তাদের সুযোগ দিন। তাতে ব্যবসা কমবে না, বরং বাড়বে। ভাল ভাল গল্প নিয়ে কাজ করা কিছু পরিচালক টাকার অভাবে নিজেই ক্যামেরা, সম্পাদনা, পরিচালনা সব কিছু করছেন শুধুমাত্র জেদ ও মনের খিদা মেটানোর তাগিদ থেকে। তাদের সামনে আনুন। প্রাধান্য দিন তাদের গল্পকে। এসব ভগ্নপ্রায়, মজে যাওয়া বিষয়বস্তু নিয়ে আর কত! সময় বদলের সাথে সাথে নিজেদের মধ্যে বদল আনা জরুরি। আপনাদের অর্থের সঠিক প্রয়োগে বাধা কোথায়! তাতে লোকসান হবে না, বরং মান বাড়বে ভারতীয় সিনেমার।
অন্তঃ সিদ্ধার্থ দেওয়ানের সিনেমাটোগ্রাফি সিনেমার মান বাড়িয়ে তুলতে সহযোগী হয়। তাতে যোগদান করে রামেশ্বর ভগৎ-এর অপূর্ব সম্পাদনা। অমিত ত্রিবেদীর সঙ্গীত গল্পের মেজাজ ধরে রাখতে সক্ষম। এই তিনের মিশেল পরিচালকের খামতি ঢাকার চেষ্টা করলেও বেড়িয়েই পড়ে কঙ্কাল। অভিনেতা, অভিনেত্রীরা তুলনামূলক ভাল কাজ করেছেন। যেহেতু তাঁদের বিশেষ কোন স্তর উন্নীত হয়নি তাই তারা অপারগ এস্টাবলিশমেন্ট-এ। রাজবাড়িটি যে মহেন্দ্র, ইন্দ্রনীল কিম্বা সত্যা কারুরই নিজের নয়, বরং ভাড়া করা, তা স্পষ্ট।
নারীবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্যের হাত থেকে বিড়ি কেড়ে নেওয়াই যায়, কিন্তু তাতে ঠোঁট কালো হওয়ার ভয় থাকলে চলে না। একসাথে কিছু দৃশ্য জুড়ে দিলে সিনেমা হয়ে যায় হয়তো। কিন্তু গল্প হয় না। গল্পকে দৃশ্যের রূপ প্রদান করলে তবেই তার চরিত্ররা জীবন্ত হয়ে ওঠে। “হরর” সিনেমায় সবকিছু সম্ভব ধরে নিলেও মাটিতে পড়ে থাকা এক টুকরো আগুন বিরাট বনকে জ্বালিয়ে দিতে পারে এমন আজগুবি কান্ড কারখানা ভয় নয়, হাসির খোড়াক জোগায়। এতে বাহবা কুড়োয় শুধুমাত্র ভিএফএক্স শিল্পী। আগামীর জন্য অনেক শুভেচ্ছা পরিচালক অনভিতা দত্ত-কে।