পোর্টজিন

জয় গোস্বামী’র ‘পড়ন্ত বেলার রাঙা আলো’ : সংরাগ মাখা প্রেমের কবিতা – সুমন ব্যানার্জি

Bengal Live পোর্টজিনঃ পোর্টজিন কি? পোর্টজিন একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহের রবিবার এটি বেঙ্গল লাইভের (bengallive.in) এর পোর্টজিন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়।

bengal live portzine suman banerjee

 

‘তুমি যতক্ষণ থাকো, বুঝতে পারি, জীবন আবার / নতুন প্রেমের দোষে দোষী !” (তরু)

১.
প্রেম তো কখন নিঃশব্দ চরণেও আসে কখন সমারোহেও আসে। তা সে যৌবনেই হোক্ বা প্রৌঢ় বয়সে ! প্রাক্-যৌবন বা যৌবনের স্বাভাবিক ধর্ম মেনে যে প্রেম তাতে থাকে বাঁধন হারা উচ্ছ্বাস , দুর্মর আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু প্রৌঢ় জীবনে সেই উচ্ছ্বাস, প্রমত্ততা অনেক বেশি প্রসাধিত। তবু স্বাদ জেগে থাকে।রক্তের মধ্যে সুপ্ত থাকে ভাষা, মনের মধ্যে সুপ্ত থাকে সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষা। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সেইসব স্বপ্নিল ছবি।শরীর যখন অশক্ত, জীবনের অনেকটা পথ চলার পথ ক্লান্ত ও শ্রান্তি তখন স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন কবি।জমে থাকা ধুলো সরাতে সরাতে আবিষ্কার করছেন ‘পুরানো আখরগুলি’। সমস্ত কবিতাগুলোতে নিবিড়ভাবে আকড়ে ধরার আততি ধরা পড়েছে।

প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রে জয় গোস্বামী’র নিজস্ব একটা ঘরানা আছে। ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ থেকে ‘পাগলি তোমার সঙ্গে’ যেভধ দুর্মর রোম্যান্টিক আবেগে উদ্বেলিত তেমনি তা ছুঁয়ে থাকে সমকালের স্বরগুলিকে। ‘পড়ন্ত বেলা’ আসলে জীবনের সায়াহ্ন আর ‘রাঙা আলো’ আসলে প্রেমের আলো।কালের অমোঘ নিয়মে বয়স তো শরীরের বাড়ে কিন্তু মনের তো বাড়ে না ! রাঙা শব্দটি অনেকটা লোকায়ত বা প্রাকৃত : রাঙা আলো ব্যঞ্জানাটি নির্দ্বিধায় প্রেমেরই ব্যঞ্জনা। প্রেম তো চিরনবীনই।যে বয়সেই আসুক তা অনিন্দ্যসুন্দরই থাকে। রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রেম হল ‘পথের আলো’।পড়ন্ত বেলার রাঙা আলো যেন আলাদা সৌন্দর্যে মথিত।

২০১৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকার (মার্চ ও এপ্রিলে) এই কবিতাগুলি “কাঁচা কবিতার গুচ্ছ” ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়।তার অব্যবহিত পরে “পড়ন্ত বেলার রাঙা আলো” শিরোনামে কাব্যে কবিতাগুলি গ্রন্থিবদ্ধ হয়।দু’টি নামের গভীরে থাকা ভাবনা যেন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে মিলে যায়।খুব জটিল কোন ভাবনা, চমকে দেবার মত কোন ইমেজারি (রূপকল্প) , কোন গভীর সমাজ বা জীবনদর্শন এর মধ্যে ছিটেফোঁটাও নেই। খুব আলগা ভাবে খোলামেলা নির্ভেজাল প্রেমের কবিতা।প্রচন্ড উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা, যৌনাসক্তিতে ভরা প্রেমের কবিতা নয়, ঠিক প্লেটোনিক লভ্ও নয় ; কবিতাগুলি নিচু স্বরে বাঁধা। অথচ প্রতিটি কবিতায় অক্ষরে অক্ষরে ছড়িয়ে রয়েছে উষ্ণতা, প্রেমাস্পদের প্রতি আকুলতা, অন্তর্লীন হয়ে আছে সুগভীর সংসক্তি।কাব্যের নাম কবিতাতেই পাচ্ছি —

“…শেষ জীবনের রাঙা হয়ে যাওয়া আলো / এখানে সঙ্গে করে এনেছে আমাকে / তার হাতে ছোট কলসি / কলসি ভরা নদী / সে এখন ধুয়ে দিচ্ছে ধুয়ে দেবে / অনাহারক্লিষ্ট কঙ্কালসার এক নটরাজের শরীর”।

অনাহারক্লিষ্ট কঙ্কালসার ‘নটরাজের শরীর’ বলতে নিজের দিকেই তাঁর তির্যক ইঙ্গিত পরিস্ফুট।

২.
প্রিয় মানুষটিকে চোখে দেখার অনুভূতিটুকুকে পুঁজি করেই কবি লিখতে চেয়েছেন কবিতা।কবি নিজেই বলছেন সেগুলি ‘দুর্বল’ লেখা।যেসব লেখায় প্রতীক,সংকেত ইত্যাদি কিছুই নেই রয়েছে শুধু ‘মন’।যে মনকে জুড়ে আছে প্রিয় মানুষটি —

“এখন দুর্বল লেখা লিখতে ইচ্ছে করে। / যার মধ্যে কিচ্ছু নেই।প্রতীক, সংকেত,রহস্য না। / শুধু মনটুকু আছে।বলো মন কাকে বলে ? বলো ? / তোমার বসার ভঙ্গি, তোমার তাকানো, হেসে ফেলা, / বা তোমার উঠে যাওয়া এই ঘর থেকে ওই ঘরে — / একহাতে জলের গ্লাস, ঠোঁটে লাগছে গ্লাসের কিনারা …”। (দুর্বল)

একজন কবির কাব্য বোধ সমৃদ্ধ হয় অন্যজন কবির লেখা পড়ে।নিরন্তর এই চর্চার মধ্যে দিয়েই কবি নির্মাণ করেন তাঁর ভাবনার বলয়টিকে। কিন্তু এইসব কিছুকেই খুব বাহ্যিক, কৃত্রিম বলে মনে হয় কবির। তাঁর আন্তরিক প্রেরণার উৎস তো একজনই প্রেয়সী বা প্রেমাস্পদ। তাঁকে কেন্দ্র করেই তো মন হয়ে ওঠে অনুরঞ্জিত।কবির প্রেম- চেতনা শিল্পসুন্দর জীবনবোধকে উদ্রিক্ত করে।কবি সরাসরি লেখেন যে —

“তোমাকে পড়েছি শুধু / যে-তুমি সারাজীবনে এক লাইনও কবিতা লেখোনি।” (কাঁচা)

কবি নিজেকে সম্বোধন করেন – ‘এক প্রৌঢ় কবিতালেখক’। যাঁর দেবার মতো বিরাট কিছু নেই, শুধু প্রেমিকাকে দিতে চেয়েছেন একটি নাম।যে নাম পোশাকি নয় , একান্তই ব্যক্তিগত।সেই নাম মার্জিত নাকি অমার্জিত তা অবান্তর।সেই নামের মধ্যে জড়িয়ে থাকে আবেগ,স্বপ্ন, সাধ আর বিশ্বাস।অনুভূতির তল থেকে উঠে আসে সেইসব নাম।বাইরের সমস্ত ভার ও চিহ্নকে মুছে ফেলে একজন কবি যেভাবে দেখতে চান তাঁর প্রেমিকাকে —

“তোমাকে দেবার মতো কিছুই তো নেই। / যদি একটি নতুন নাম দিই / নেবে তুমি ? সেই নাম কোনও জয়টিকা / পারবে না তোমার কপালে। / এক প্রৌঢ় কবিতালেখক / ও-নামকরণে শান্তি পাবে … তখন অঘ্রানমাস। সেইদিন থেকে মনে মনে / তোমাকে ডেকেছি হেমন্তিকা !” (নেবে তুমি ?)

৩.
সাদা সালোয়ার কামিজে ঘরে ঢুকেছে।কবির লেখা নতুন বইয়ের পাতা ওল্টালো।কবি নিজেই চা করে খাওয়ালেন না।এ কথা সে কথা বলতে বলতে তাঁর হাসির শব্দ যেন ঘরময় ডানা মেলে – ‘তোমার হাসির শব্দ সারা ঘরে মেলে দেয় ডানা’। কবি কবিতায় অনুক্ত রাখেন তবু ইঙ্গিতটুকু স্পষ্ট যে তাঁরও ইচ্ছে হয় উড়ে যাই অনেক দূরে সেই মানুষটির সঙ্গে।জানলার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে অস্তাভা রাঙা রঙ – জাগিয়ে তোলে তাঁর গোপন ইচ্ছেগুলোকে।কবির যেন মনে সেই মানুষটি তাঁর মনের সব চলাচলেরই খবর রাখেন —

“যে-বয়সে পৌঁছে গেছি সেখানে কি মন বলে আর কিছু থাকে ? / যদি থাকে, বলো / আমার মনের কথা তোমার কি জানা ?” (জানা ?)

রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান হল জীবনবেদ। যাঁর প্রতিটি পাতার অক্ষরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীবন স্পন্দন। যেখানে পূজা, প্রেম, প্রকৃতি সব কিছুই মিলে যায় এক তরঙ্গ রেখায়।এমন একটি বই যা মানুষকে আশ্রয়ও দেয় আলোও দেয়, যন্ত্রণা,শোক,কষ্টে বিহ্বল মানুষকে শান্তি দেয়, বীতশোক করে।যে কথা আমরা বলতে পারি না সেই কথা রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বলে গেছেন তাঁর গানে, সবার সব অনুভূতিকেই তিনি মূর্ত করেছেন ভাষায় —

“আসলে প্রতিটি পৃষ্ঠা ধরে আছে একজন কবির / অতল সমুদ্রগামী মন / বুঝে বা না – বুঝে তবু এক সন্ধ্যাঘরে / গীতবিতানের হাতে বন্দি হয়ে রয়েছে দু’জন”।

প্রেমে রয়েছে একরকমের অস্থির অনুরুক্তি। পরিণাম কী হবে তা সেখানে অর্থহীন।সেই মানুষটি হয়তো অনেক দূরে , কোনদিন সে ফিরবে না এটাই বাস্তব, বিরহ নিয়েই বাঁচতে হবে।তবু অপেক্ষার একটা মাধুর্য আছে যা শুধু প্রেমিকই বোঝে ! বারবার সেই মানুষটির ছবিই ভেসে আসে, তাঁর সবটুকুই মনকে আন্দোলিত করে —
“সমুদ্রের কিনারে বালিতে / আমার আঙুল দিয়ে সযত্নে তোমার নাম লিখি / একটু পরই ঢেউ আসবে।ধুয়ে যাবে। ঠিকই। / জানি।তবু লিখি…”।(জানি।তবু…)

৪.
প্রচলিত মিথ আছে কোন মানুষ দূরে চলে গেলে বা বিশেষত না ফেরার দেশে চলে গেলে সে আকাশের তারা হয়ে জ্বলে।যুগে যুগে কাব্য কবিতায় গানে এই প্রাচীন লোকবিশ্বাসটি অনেকবার ঘুরে ফিরে এসেছে।প্রেমিকের চোখে আকাশ ভরা তারাতে ফুটে ওঠে তাঁরই কথা, তাঁরই হাসি।সে যেন অনেক রকম বার্তা পাঠায়। একমাত্র কবিই সেই সাংকেতিকতা উপলব্ধি করতে পারেন।যেমন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে – ‘তোমারই নাম সকল তারার মাঝে ঐ বাজে।’ জয় লিখছেন যে —

“কথা বলার চেষ্টায় আকাশ / একটি তারা ফুটিয়েছে। / দ্বিতীয় তারাটি / তোমার উত্তর : / হ্যাঁ আমি কালকেই আসছি, দুপুরের পর”। (বার্তা)

দু’জন মানুষের অনুভূতি মিলে যাচ্ছে এক জায়গায়। কিন্তু সেই ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দেয় না সামাজিক অনুশাসন।আশ্চর্য সুন্দর কবিতা —

“তুমি এই বারান্দার ধারে / দাঁড়িয়ে নিশ্বাস নাও।একই বারান্দায় / আমিও তো শ্বাস নিচ্ছি।একই তো বাতাস দু’জনের / বুক ভরে দেয় … / এক-ই তো, এক-ই তো, বলো, এক-ই তো, এক-ই তো … / তা হলে দু’জনে কেন আলাদা আলাদা থাকবে ? লোকভয়ে ভীত ?” (এক-ই তো)

পরকীয়া প্রেমের তির্যক ইঙ্গিত বহন করে কবিতাটি।সমাজের কাছে যা স্বকীয়া বা পরকীয়া তার কোন ভেদ কবি বা শিল্পীর কাছে নেই।কোন স্থূল সম্ভোগ তাঁর উদ্দেশ্য নয়, যা কিছু তাঁর দৃষ্টিতে সুন্দর তাকেই সে উপভোগ করতে চায়, সেই আনন্দকে কানায় কানায় নিতে চায়। তাঁর রয়েছে সৌন্দর্য সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা।

৫.
কবি লিখছেন যে — “প্রথম বর্ষের ছাত্র যেরকম লেখে, সেরকম / সহজ আবেগ লেখো। / বলো যে এখনও তীব্র রোদ বৃষ্টি পড়ে / মনে … / এখনও ক্ষত-বিক্ষত হতে পারো প্রেমের দংশনে !” (তেষট্টি বছর)

এই সহজ নিখাদ আবেগগুলোই সারা জীবনের সম্বল হয়ে থাকে, স্রষ্টার কাছে হয়ে ওঠে সৃষ্টির অম্লান রসদ।আসলে কোন প্রেমিক যদি শিল্পী হয় অর্থাৎ তাঁর যদি তীব্র সংবেদী অনুভূতির জগৎ থাকে তবে সে বোঝে যে প্রেমের দংশনের মধ্যেও এক রকমের আনন্দ থাকে।যার বেশিরভাগটাই অব্যক্ত, অনির্বচনীয়।কবি একদম মজার ছলে বলেন যে —

“এইসব লেখাপত্র আসলে কিছুই কিছু নয়
তোমাকে চোখের দেখা দেখব বলেই এই বাঁচা।” (তোমাকে)

তথ্যসূত্র (আকর গ্রন্থ) :—–
১. পড়ন্ত বেলার রাঙা আলো, জয় গোস্বামী, সিগনেট প্রেস, প্রথম সংস্করণ – জানুয়ারি, ২০১৯।

কীভাবে লেখা পাঠাবেন?
নীচে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার কিংবা ইমেল আইডিতে লেখা পাঠাতে পারবেন।
হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার~ 9635459953
ইমেল আইডি~ bengalliveportzine@gmail.com
লেখার সঙ্গে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং একটি ছবি পাঠানো আবশ্যক।
ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে নিজের তোলা দুটো ছবি পাঠাতে হবে।

Related News

Back to top button