জীবনানন্দ দাশ ও ফরাসি কবিতা – সুমন ব্যানার্জি (হুগলী)

Bengal Live পোর্টজিনঃ পোর্টজিন কি? পোর্টজিন একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহের রবিবার এটি বেঙ্গল লাইভের (bengallive.in) এর পোর্টজিন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়।

 

 

১. আধুনিক কাব্যান্দোলনে ফরাসি সাহিত্যের ভূমিকা অগ্রপথিকের মতো। ইংল্যান্ডে রোম্যান্টিসিজম্,ইমেজিজম্, জার্মানির এক্সপ্রেশনিজম্ নিঃসন্দেহে শিল্প ও সাংস্কৃতিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে কিন্তু ফ্রান্সের ডাডাইজম্ ও তারপর সুররিয়ালিজম্ এবং সিম্বলিজম্ সবচেয়ে শক্তিশালী অভিঘাত তৈরি করে চিন্তাবিশ্বে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক জীবনানন্দ যে স্বতন্ত্র কাব্যভাষা সৃষ্টি করেন তার পশ্চাতে ছিল ফরাসি সাহিত্যের বিপুল প্রণোদনা। সময় বা যুগ অনেক সময় একজন কবিকে গড়ে নেয় যার সার্থক দৃষ্টান্ত জীবনানন্দ। ‘দেশ কাল ও কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে লিখছেন যে-
“ফরাসী কাব্য কোনো কোনো সময় ইংল্যান্ডের বড় কাব্যের পথ কেটে দিয়েছে, ঢল নামিয়েছে।”

ফরাসি কাব্য তথা ভাবনা কীভাবে জীবনানন্দের চিন্তার জগতে অনুভাবিত হয়েছে এবং তা বাংলা কবিতার জগতে নতুন পরিসর নির্মাণ করেছে উত্তরকালের জন্য সেটাই প্রবন্ধের মূল অন্বিষ্ট। এই সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ও সমন্বয় আবহমান বাংলা কবিতার এক অলোক সামান্য অধ্যায়।

২. শিল্পী মাত্রই রোম্যান্টিক। রোমান্টিসিজম্ নিছক বিশ্ব সাহিত্যের একটি তাত্ত্বিক শব্দ নয়। রোমান্টিকতা সমাজ, রাজনীতির যান্ত্রিক ও প্রাণহীন কাঠামো থেকে মানুষকে বিশ্ব প্রকৃতির বিপুল বিস্ময়,সৌন্দর্য্যের সামনে আনে। বুদ্ধদেব বসু যথার্থই লেখেন যে-
রোমান্টিকতা মানুষের একটি মৌলিক,স্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য চিত্ত বৃত্তি।মানুষের মধ্যে যা কিছু যুক্তির অতীত,অনিশ্চিত,অবৈধ,অন্ধকার ও রহস্যময়,যা কিছু গোপন, পাপোন্মুখ ও অকথ্য -সেই স্ববিরোধময় বিস্ময়ের সামনে দাঁড়াবার শক্তিই রোমান্টিকতা। প্রায় গোটা ১৯ শতক জুড়ে বিশ্ব সাহিত্যের অনুঘটকের কাজ করেছে রোমান্টিকতা।
ধ্রুপদীয়ানার যুক্তি শৃঙ্খলকে ভাঙতে পেরেছিল রোমান্টিকতা।কিন্তু এর মধ্যেও ছিল বৈচিত্র্যহীনতা ও স্বগতোক্তি পূর্ণ কথার পৌনঃপুনিক ব্যবহারে ক্লান্তি।তাই ভিন্ন পথ নির্মাণের প্রয়োজন ছিল।আর সেই কাজটিই করলেন শার্ল বোদল্যের।এক নতুন স্বর শ্রুত হল- যাকে তারই অনুরাগী অনুজ কবি আর্তুর রাবো (Arthur Rimbaud) বলেছিলেন – ‘ প্রথম দ্রষ্টা,কবিদের রাজা,এক সত্য দেবতা।’আধুনিক কাব্যের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হল। ইংল্যান্ডে ব্লেইক,কীটস; জার্মানির নোভালিস,হ্যেল্ডার্লিন; ফ্রান্সে নেরভাল ও গোতিয়ে, আমেরিকার আ্যডগার এলান পো, হুইটম্যান প্রমুখ কবিদের মধ্যে আধুনিকতার ঝলক দেখা গেলেও তা অনেক বেশি সংহত ও সুগ্রথিত হল বোদল্যের’র মধ্যে।তিনি সেই অর্থে কোন কাব্য তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন না কিন্তু তিনি আবির্ভূত না হলে ‘ডাডাইজম্’,’সুররেয়ালিজম্’ ও ‘সিম্বলিজম্’র মত তাত্ত্বিক আন্দোলন শক্ত জমি পেত না।J.M Cohen তাঁর ”Poetry of this Age (1908-1965)” শীর্ষক গ্রন্থে লিখছেন যে –
“Boudelaure,indeed provided a new thrill,which shocked and horrified a Paris.”

বোদল্যের তাঁর বিশ্বনন্দিত ”Les Fleur du mal” গ্রন্থে স্পষ্টত তুলে ধরলেন ‘এক দ্বন্দ্বপীড়িত আত্মভেদী চৈতন্য’-কে। এবং এই অনুষঙ্গে চিত্রিত করলেন প্যারিসের নাগরিক জীবনের ক্লেদ, বিরক্তি, যন্ত্র চালিত জীবনের ক্লান্তি ও যৌন বিকৃতিকে।রোমান্টিক স্রষ্টারা সন্ধান করলেন সৌন্দর্যের সারাৎসার (‘An artist is an artist only by dint of his exquisite sense of Beauty.’) কিন্তু বোদল্যের দেখালেন কুৎসিতের নন্দনতত্ত্ব (‘An aesthetic of the ugly.’)।রেনে ওয়েলেক কথাটি ব্যবহার করেন। জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে তাঁর কবিতার সংক্ষেপে তুলনামূলক আলোচনা করব।
বোদল্যের তাঁর কবিতায় লিখেছেন যে-
“নীচু আর ভারী সেই আকাশ যখন এক ঢাকনার মত/চেপে ধরে আত্মাকে যে দীর্ঘকাল চিন্তায় পীড়িত/এবং যখন মানুষের চক্ষু দিয়ে যতদূর দেখা যায়/সে বিছালো অদ্ভুত আঁধার এক রাত্রির চেয়েও বেশি বিষাদে খচিত/পৃথিবী যখন বদলিয়ে হয়ে গেছে নির্জন কারাগার ঘর/সেইখানে স্যাঁতানো আঁধারে তার ভীতু ডানা নিয়ে/ আশা এক বাদুড়ের মত হয়ে দেয়ালের বুকে করে ঝপট আঘাত/ক্ষয়িষ্ণু ভিতর ছাদ ঠোঁটে মাথা দিয়ে।” (‘Spleen’,Spleen et ldeal, ভাষান্তর – মঞ্জুভাষ মিত্র )
এক কথায় নগরজীবনের প্রভূত সম্ভোগ ও প্রাচুর্যের নেপথ্যে থাকা নগ্নতার ও ক্ষয়িষ্ণু জীবনের ছবি।টি.এস.এলিয়ট তাঁর মিথ প্রতিম ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতায় যে আধুনিক বিকারগ্রস্থ জীবনের রূপকল্প ফুটিয়ে তোলেন।

এরূপ অস্থির, যন্ত্রণাময় অদ্ভুত আঁধারে যেখানে ‘প্রেম নেই, প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই’ নাগরিক জীবনের স্বার্থপরতা, নিঃসঙ্গতা ,মননহীনতা ও অনিকেত মনোবৃত্তি প্রবলভাবে জীবনানন্দের কাব্য দর্শনেও উপস্থিত। তাঁর “মহাপৃথিবী”র ‘ফুটপাত’ কবিতায় পাচ্ছি –
“অনেক রাত হয়েছে – অনেক গভীর রাত হয়েছে ;/কলকাতার ফুটপাতে থেকে ফুটপাতে – ফুটপাত থেকে ফুটপাথে/কয়েকটি আদিম সর্পিনী সহোদরার মত/এই- যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে/পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ/অনুভব ক’রে হাঁটছি আমি/গুঁড়ি – গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে,কেমন যেন ঠান্ডা বাতাস;…”

এক মানসিক বৈকল্য, বিষাদগ্রস্ততা ও অবসাদ যা আধুনিক কবিতার বড় পরিসরে উঠে আসছে। দ্বিধা ও সংশয়ান্বিত হওয়াটাই আধুনিক ভবিষ্যত মানবের নিয়তি।

৩. ডাডাইজম্ বস্তুত এক ধ্বংসাত্মক আন্দোলন রূপে আত্মপ্রকাশ করে।যার মূল বক্তব্যই ছিল – ভাষার সমস্ত ঠাট,ভড়ং ভেঙে দাও এমনকি ভাষাকেও প্রয়োজনে বাদ দিলো না। প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তি লগ্নে এক প্রচন্ড স্থিতিহীন অস্থির আবহে এঁদের আবির্ভাব। তাঁদের অমিতাচার ও বল্গাহীন জীবন আসলে সময়েরই ফলশ্রুতি।তবে এত কিছুর মধ্যেও রূপালি দিকটি হলো – যুক্তির শৃঙ্খলকে পুরোদস্তু খারিজ করে মনকে অবাধে চলতে দেওয়া।আদিম জীবনের প্রতি ছিল এঁদের প্রবল আকর্ষণ।সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য উদ্ভট কল্পনার জগত তৈরি করে এঁরা।ঠিক এরপরই গড়ে উঠল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী কাব্যান্দোলন স্যুররেয়ালিসম্।যার মূল প্রোথিত ছিল পূর্ববর্তী ডাডাইসম্’র মধ্যে।বোদল্যের,রাবো,লোত্রেয়াম প্রমুখ’র লেখাতেও স্যুররেয়ালিস্তদের আভাস ছিল। কিন্তু পূর্ববর্তী রোমান্টিকদের থেকে এদের পার্থক্য হল – আগের আমলে যুক্তিবাদকে বাদ দিতে গিয়েও যুক্তির সঙ্গে রফা করেছে। কিন্তু স্যুররেয়ালিজম্ কাব্য থেকে যুক্তি জড়িত সমস্ত উপাদানকেই অপহ্নব করতে চাইল। অবচেতনই হয়ে উঠল কাব্যের উৎস (স্যুররেয়ালিজম্ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন গীয়ম আপলিনের)।এই আন্দোলনের পুরোধা আঁদ্রে ব্র্যত তাঁর ইস্তাহারে ঘোষণা করলেন – আমি বিশ্বাস করি যে,বাহ্যত বিরোধী এই দুই দশা অর্থাৎ স্বপ্ন এবং বাস্তব অপসৃত হয়ে তাদের থেকে উদ্ভূত হবে এক নতুন বাস্তব।

কোন মতবাদেরই যুক্তি বিবর্জিত দাসত্ব স্বাধীন চিন্তার বিবর্ধনের পক্ষে প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ।স্যুররেয়ালিস্তরা কাব্যের মুক্তির সঙ্গে জীবনের মুক্তির অন্বয় তাঁরা ঘটালেন। বাংলায় জীবনানন্দের কবিতায় এই কাব্য দর্শন প্রবলভাবে সমুদ্ভাসিত হয়েছে।ঝ্যুল স্যুপেরভিয়েল ও পিয়ের রভেরদি দু’জন বিশিষ্ট স্যুররেয়ালিস্ত কবি। স্যুপেরভিয়েল নিজে লিখেছেন যে – ‘আমি অনুভব করি একই সময়ে আমি সর্বত্র উপস্থিত আছি যেমন স্থানের মধ্যে তেমন হৃদয় ও চিন্তার বিভিন্ন এলাকায়।’ মানুষ,পশু,সবুজ প্রকৃতি সমস্ত কিছুর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা। তাঁর দু’টি কবিতাংশ উদ্ধৃত করা যাক্ –
ক)”এই গাছ এত কাছাকাছি,ওর মিল/সেই সব অপূর্ব স্মৃতির সঙ্গে যারা তাদেরই/ভস্মের মধ্যে নড়ে।” (ভাষান্তর – কবি অরুণ মিত্র)
খ)”এই তো সুন্দর এই যে দেখছি/পত্রগুচ্ছের নীচে ছায়া/এই যে অনুভব করেছি/বয়স নগ্নদেহের উপর সঞ্চরমান/আমাদের ধমনীর কালো রক্তের/বেদনার সঙ্গী হয়েছি…”(ঐ)

জীবনানন্দের কবিতাতেও বিশেষত তাঁর ”রূপসী বাংলা”র লেখাতে অদ্বিধভাবে উপস্থিত সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে চেতন সত্তার নিবিড় স্পন্দন –
“খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন কাহিনীর দেশে/’পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,/কলমীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীড়ে -/নীরবে পা ধোয়া জলে একবার – তারপর দূরে নিরুদ্দেশে”।
স্থান-কাল-পাত্রের ভেদরেখা লুপ্ত হয়ে এক অলৌকিক মায়ার জগতের আবরণ উন্মোচিত হয় -“যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে/অপরাজিতার মতো নীল হয়ে – আরো নীল – আরো নীল হয়ে/আমি যে দেখিতে চাই ; -সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায়ে লয়ে/কোথায় ভোরের বক মাছরাঙা উড়ে যায় আশ্বিনের মাসে,…”।

পিয়ের রাভেদির কবিতার মধ্যে অনুভূত হয় হাহাকার, স্তব্ধ নিশ্চলতার মধ্যে বিকীর্ণ হয় এক প্রকার বিষণ্ণতা – “সব নিবে গেছে/হাওয়া মর্মর শব্দে বইছে/আর গাছগুলো শিউরে উঠছে/জন্তুরা মরে গেছে/কেউ আর নেই/দ্যাখো/তারারা আর জ্বলছে না/পৃথিবী আর ঘুরছে না/একটা মাথা ঝুঁকে পড়ছে/তার চুল রাতের উপর দিয়ে ছড়িয়ে আছে/শেষ গির্জাচূড়া দাঁড়িয়ে/রাত বারোটা বাজাল।” (ভাষান্তর – অরুণ মিত্র)

জীবনানন্দের লেখাতেও পাব -“দূরে কাছে কেবলি নগর ঘর ভাঙে;/গ্রাম পতনের শব্দ হয়;/মানুষের ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে,/দেয়ালে তাদের ছায়া তবু/ক্ষতি, মৃত্যু,ভয়,/বিহ্বলতা বলে মনে হয়।” (‘পৃথিবীলোক’)
যন্ত্রসভ্যতার এই অমানবিক জঙ্গলে জীবনের ক্ষয়কে টের পেয়েছিলেন।একটা গতিবিহীন ভঙ্গি স্থবির ও অবসন্ন করছে আমাদের – “সব কাজ তুচ্ছ হয়, — পন্ড মনে হয়,সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়,/শূন্য মনে হয়,/শূন্য মনে হয়।” (‘বোধ’ , “ধূসর পান্ডুলিপি”)

৪. স্যুররেয়ালিস্ত আন্দোলন থেকে আরো একটি মানবমুখী শিল্পান্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল – হিউম্যানিটেরিয়ানিজম্।তবে এর পশ্চাতে কমিউনিজমের একটা বড় ভূমিকা ছিল।এই সময়ের তিনজন প্রতিনিধি স্থানীয় কবি হলেন – আরাগঁ,পর এল্যুয়ার যিনি আজো কিংবদন্তি প্রতিম এবং ত্রিস্তাঁ ৎজারা।আরাগঁ’র কবিতা এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনা সঞ্চারিত করেছিল যুদ্ধকালীন সময়ে পরাধীন জাতির মনে।তিনি সরাসরি স্যুররেয়ালিজম্’র পথ থেকে সরে এসে কবিতায় এক আশ্চর্যরকম গীতিময়তা সৃষ্টি করেন।বলা বাহুল্য এর মধ্যে ছিল এক জাতীয়তাবাদী আবেগ।এই পটভূমিতেই আরও একজন কবির আত্মপ্রকাশ ঘটল তিনি পল এল্যুয়ার।’চিত্রকল্পের স্বকীয়তায় ও সমৃদ্ধতায়, অনুভবের ঘনিষ্ঠতায়, প্রেমের অকৃত্রিম মানবিক ব্যঞ্জানায়’ তাঁর কাব্য অতুলনীয়। তিনি লিখেছেন – “আমি ছিলাম মানুষ আমি ছিলাম পাথর/আমি ছিলাম মানুষের ভিতরের পাথর পাথরের ভিতরের মানুষ/আমি ছিলাম আকাশে পাখি পাখিতে শূন্য/আমি ছিলাম শীতে ফুল সূর্যে নদী/শিশিরের ভিতরে চুনি/ভ্রতৃত্বে একক ভ্রাতৃত্বে মুক্ত।”
এক সহজ, নির্মেদ ও নিবিড় অনুভূতিতে বাঙ্ময় তার সৃষ্টি। নিজের সত্তার এই এই বাধা বন্ধহীন বৈশ্বিক ব্যাপ্তি ফরাসি কবিদের চৈতন্যে মগ্ন।মূল উদ্দেশ্য একটাই মানবমুখী ও উদার শিল্প ভাবনাকে নানা বৈচিত্র্যে সম্প্রসারিত করা। জীবনানন্দের কবিতাতেও আমরা পাব – ” ‘আছে আছে আছে’ এই বোধির ভিতরে চলেছে/ নক্ষত্র, রাত্রি, সিন্ধু, রীতি, মানুষের বিষয় হৃদয়;/জয় অস্তসূর্য,জয়,অলখ অরুণোদয়,জয়।–”
এই সূর্যই আসলে সূচিত করবে নতুন দিনের তাঁর কথায় ‘শুভ্র মানবিকতার ভোর’র।ৎজরাও নিজেকে মানবতাবাদী বলেছিলেন ‘পূর্ণতার অস্তিত্বের জন্য মানুষের প্রয়াস এবং মনোজগতের অন্তহীন আন্দোলন’ – দু’য়ের এক সমন্বয় সৃষ্টির চেষ্টা তিনি করেন।

পল এল্যুয়ারের একটি প্রেমের কবিতা –
” রাত্রিরা উষ্ণ আর শান্ত/আমরা ধরে রাখি প্রেয়সীদের কাছে/সবচেয়ে মূল্যবান এই বিশ্বস্ততা:/বাঁচার আশা।” জীবনানন্দের কবিতাতেও পাই – “সময় এসে আমার কাছে একটি কথা জানতে চেয়েছিল,/তোমার কাছে একটি কথার মানে;/আমরা দুজন দু দৃষ্টিকোণ দিতাম তাকে হেসে/একটি শরীর হতাম পরস্পরকে ভালোবেসে।” (ভাষান্তর – অরুণ মিত্র)
প্রতিবাদ, বিদ্রোহ ও প্রেম সবটা মিশে যায় এক বাণবেঁধার বিন্দুতে। স্থবিরতার অচলায়তন ভেঙে উন্মুক্ত করবে এক নতুন সম্ভাবনার পরিসর। জীবনানন্দ লিখছেন – “এসো আমরা যে যার কাছে – যে যার যুগের কাছে সব/সত্য হয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠি।…কোথাও সূর্যের ভোর র’য়ে গেছে বলে মনে হয় !” (‘সূর্যপ্রতিম’)নারী তাঁর কাছে অফুরন্ত প্রাণশক্তির প্রেরণা কিন্তু তিনি তা বাস্তবে পান না। নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে সেই বিশ্বাস, নির্ভরতা আর অটুট নেই।কবির বেদনা, অভিমান ও বক্রোক্তি – “একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালো বেসেছিল;/তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিল দশজন মূর্খের বিক্ষোভ”। (‘মনোকণিকা’) তাঁর কাছে জ্ঞান ব্যতীত প্রেম অসম্পূর্ণ ও অর্থহীন।

৫. প্রতীকবাদ/সিম্বলিস্ত কাব্য দর্শন আরো একটি নতুন দিগন্তের সন্ধান দেয়।মালার্মে ছিলেন অন্যতম পুরোধা। কবিতার মধ্যে দিয়ে যে ঐন্দ্রজালিক জগৎ সৃষ্ট হয় তা কোন না কোন সংকেতকে দ্যোতিত করে।আর্তুর র্যাঁবো ছিলেন প্রতীকীবাদের অগ্রদূত।তিনি নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন,কখন ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন। তাঁর কবিতায় শোনা যায় যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয়ের আর্তনাদ। পাশাপাশি নিবিড় স্বপ্নময়তা, প্রকৃতি প্রেম ও ঐতিহ্য চেতনা ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়।পল দেমেনি’কে প্রদত্ত চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে – কবি রচনা করবেন নিরাবয়বের অবয়ব ও অবয়বের নিরাবয়ব। খুঁজে নেবেন এমন একটি ভাষা যে ভাষা হবে আত্মার জন্য আত্মার এবং এতে থাকবে গন্ধ, শব্দ,বর্ণ ও চিন্তার সমারোহ।

জীবনানন্দের নান্দনিক ভুবনও গন্ধ-বর্ণ ও শব্দেরই। তাঁর কবিতা এমন এক জগতে নিয়ে যায় যা ‘আলোছায়ার অদ্ভুত সম্পাতে রহস্যময়, স্পর্শগন্ধময়,অতি-সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়চেতন জগৎ যেখানে পতঙ্গের নিশ্বাসপতনের শব্দটুকুও শোনা যায়,মাছের পাখনার ক্ষীণতম স্পন্দনে কল্পনার গভীর জল আন্দোলিত হ’য়ে ওঠে।’ মালার্মে মনে করতেন যে ফুলের পরিচয় স্থান/চেহারার মাহাত্ম্যে নয়,তাকে পাওয়া যায় ভাব মাহাত্ম্যে। ফুল হল সাংকেতিক ও সংগীতময় কোন ধারণা। জীবনানন্দ এই কাব্য দর্শনের দ্বারা যে গভীরভাবে প্রণোদিত হন তার পরিচয় মেলে তাঁর গদ্য গ্রন্থ “কবিতার কথা”তে। তাঁর দু’টি বক্তব্য উদ্ধৃত করব –
ক)”সাধারণত বাস্তব বলতে আমরা যা বুঝি তার সম্পূর্ণ পুনর্গঠন তবুও কাব্যের ভিতর থাকে না ; আমরা এক নতুন প্রদেশে প্রবেশ করছি। পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা করা যায়…।”

খ)” সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়,এমন বর্ণ দেখা যায়,এমন আঘ্রাণ পাওয়া যায়,এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত-লাভ করা যায় – কিংবা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচিত হয়,যে মনে হয় এই সমস্ত জিনিসই অনেকদিন থেকে প্রতিফলিত হয়ে কোথায় যেন ছিল;… এবং ভঙ্গুর হয়ে নয়,সংহত হয়ে… কোথায় যেন রয়ে যাবে;এই সবের অপরূপ উদগীরণের ভিতর এসে হৃদয়ে অনুভূতির জন্ম হয়, নীহারিকা যেমন নক্ষত্রের আকার ধারণ করতে থাকে তেমনি বস্তু-সঙ্গতির প্রসব হতে থাকে যেন হৃদয়ের ভিতরে; এবং সেই প্রতিফলিত অনুচ্চারিত দেশ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে ওঠে যেন, সুরের জন্য হয়;এই বস্তু ও সুরের পরিণয় শুধু নয়,কোনো কোনো মানুষের কল্পনামনীষার ভিতর তাদের একাত্মতা ঘটে – কাব্য জন্ম লাভ করে।”

৬. শিল্প ও জীবনকে যে এক তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যে মিলিয়ে দেওয়া যায়, শিল্পকে অবলম্বন করে যে বাঁচার, চিন্তার এক বিকল্প পরিসর সৃষ্টি করা যায় তা ফরাসিরাই শিখিয়েছে। জীবনানন্দ ফরাসি কাব্যের মূলধারাগুলিকে আত্মস্থ করেছিলেন। পোস্ট-রোম্যান্টিক সময়ের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনিই আধুনিক সময়ের আর এক নতুন সময়ের স্বরকে বাংলা কবিতায় তুলে ধরলেন।যা ঠিক শাশ্বতভাবে আধুনিক নয়। প্রকৃতিচেতনা,সমাজচেতনা, মৃত্যু চেতনা, অবচেতনার এমন এক নতুন ডিসকোর্স তিনি তুলে ধরলেন যা আগে কেউ দেখাননি। তিনি যে রবীন্দ্রনাথের বাণী বিশ্ব থেকে বেরিয়ে এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষা ও দর্শনকে বাংলা কাব্যে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন তার পশ্চাতে অদ্বিধভাবে ছিল ফরাসি কাব্যের বিপুল প্রেরণা।।

তথ্যসূত্র::—

আকর গ্রন্থ :
—————–
১.মহাপৃথিবী, জীবনানন্দ দাশ,সিগনেট প্রেস প্রকাশনী, সংস্করণ – ১৪০৯।
২.ধূসর পান্ডুলিপি, তদেব, সংস্করণ – ১৪১৩।
৩.সাতটি তারার তিমির, ঐ ,অরুণা প্রকাশনী, সংস্করণ – ১৪১০।
৪.রূপসী বাংলা,তদেব, সংস্করণ -১৪১৩।
৫.কবিতার কথা,তদেব, সংস্করণ – ২০১৫.
৬.প্রবন্ধসংগ্রহ ১ অরুণ মিত্র (সম্পাদনা – চিন্ময় গুহ), গাঙচিল প্রকাশনী, সংস্করণ -২০১২।
৭.ইউরোপীয় সাহিত্যের পটভূমিতে জীবনানন্দের কবিতা, পার্থ গোস্বামী, পুনশ্চ প্রকাশনী, সংস্করণ – ২০০৭।
সহায়ক সূত্র::—–
——————
১.প্রবন্ধ সংকলন – বুদ্ধদেব বসু,দে’জ পাবলিশিং, সংস্করণ – ২০১২।
২.অন্য দেশের কবিতা,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ প্রকাশনী, সংস্করণ – ১৪১৬।

(সমাপ্ত)

সুমন ব্যানার্জি।(রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর বাংলা প্রাক্তনী)

১৪৬ কবি কিরণধন রোড ভদ্রকালী হুগলী।পিন – ৭১২২৩২।

 

 

কীভাবে লেখা পাঠাবেন?
নীচে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার কিংবা ইমেল আইডিতে লেখা পাঠাতে পারবেন।
হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার~ 9636459953
ইমেল আইডি~ bengalliveportzine@gmail.com
লেখার সঙ্গে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং একটি ছবি পাঠানো আবশ্যক।
ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে নিজের তোলা দুটো ছবি পাঠাতে হবে।

Exit mobile version