লাইন — শুভ্র মৈত্র

Bengal Live পোর্টজিনঃ

লাইন — শুভ্র মৈত্র

ভাত খেতে বসলেই যত বায়নাক্কা, সন্তুর রকম সকম দেখে মাথাটা গরম হয় সবিতার। বাপের যেন হোটেল আছে! খেতে হলে খা, নাহলে পেটে কিল মেরে থাক!—বলতে ইচ্ছা করে। অবশ্য বলতে পারে না, সত্যিই না খেয়ে থেকে যাবে। একদম এই বস্তির স্বভাব পেয়েছে ছোঁড়াটা। এই হ্যান্টামো সবিতা খুব জানে। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই দেখছে।

বিয়ের পর সবিতা প্রথম যখন এলো এই বস্তিতে তখন তো শাড়িও পড়তে শেখেনি ভালো করে, ভয় লাগতো সবকিছুতেই। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। আর সবচেয়ে সিঁটিয়ে যেত রেলগাড়ির ওই ঝমঝম শব্দে। মা গে, একবারে ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে যায় যেন! চমকে উঠতো। ঘুমের ভিতর ধরপড়িয়ে উঠে পড়েছে কতদিন! সন্তুর বাপ তখনও সন্তুর বাপ হয় নি, ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করতো, ‘ও কিছু না টেড়েন যেইছ্যে, নিদ পার’।

সেই থেকেই তো রেললাইন নিয়েই ঘর করছে সবিতা। দুটো থেকে চারটা, চারটা থেকে ছয়টা, আটটা… সব জোড়ায় জোড়ায় বাড়ে। লাইন বাড়ে আর সবিতারা ঘর নিয়ে পিছায়, আরও পিছে। ব্যাকটি নাকি তাদের যায়গা, ইচ্ছা করলে পুরোটাই দখল নিতে পারে। তা দখল নিতে এসেছিলও তো, হুজ্জোতি কম হয়েছে? বস্তির মানুষ, নেতা মাথা, পুলিস –সে মেলাই কাঁইকিচির। তখনও হ্যাণ্টামো দেখেছে এদের। দখল নিতে দেয় নি, গিরিলও লাগাতে পারে নি এখনও।

সবিতা জানে এসব নিয়েই থাকা লাগবে। আর পার হতে লাগবে ঐ লাইন। ডেলি। ডানদিক বাঁদিক দেখে পার হবে। লাইনের লাল বাতি দেখে পার হতে হয়। এখন সারাদিনে এত গাড়ি যায়! সবিতার অভ্যাস হয়ে গেছে এতদিনে। ওদের সবারই। পার হতে তো হবেই, লাইনের ওপারেই তো ভাত কাপড়। সবিতার ফেলাট বাড়িতে রান্নার কাজ, সন্তুর বাপের খুরপি-ছেনি নিয়ে টাউনের মোড়ের মাথায় গিয়ে খাড়া হওয়া—সবকিছুর জন্যেই তো লাইন টপকাতে লাগে।
আর শুধু কি পার হওয়া? লাইনের ধারে ভিজা কাপড় শুকানো, রোদ পোহানো, উকুন বাছা, মঞ্জুর মায়ের বড়ি দেওয়া, সন্ধ্যার পরে ব্যাটাছেলেদের নেশার ঠেক, বাচ্চাদের পাথর ছুঁড়ার খেলা—সবই তো লাইনের ধারেই। সন্তুর বাপের ভারী হাতের মার খেয়ে কতদিন এখানেই এসে বসে থেকেছে রাতের বেলা, লাইনগুলা কত নরম লাগে তখন।

আর এতদিন পরে রাতের ঘুম আর রেলের শব্দে ভাঙে না, শব্দ শুনে চিনে নিতে পারে কোনটা কলকাতা, কোনটা কাটিহার, আর কোনটায় মানুষ নাই, মালগাড়ি। সারাদিন পরে হা ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় নিলে রেলগাড়ির ঝমঝম যেন ঘুমপাড়ানি গান।

রেল না চললেই ফাঁকা লাগে। কয়েকদিন ধরেই সব গাড়ি বন্ধ। আর বন্ধ সবিতার লাইন পার হওয়াও। ফেলাটের বৌদি যেতে বারণ করেছে। কী সব নাকি অসুখ। টাকা অবশ্য দিয়েছিল।
কয়দিন তো ভালোই ছিল ঘরে। সন্তুর বাপেরও বাইরে যাওয়া নাই। চাল-আটা এসেছিল নেতার বাড়ি থেকে। লাইন পার হয়েই যেতে হয়েছিল অবশ্য।

তারপর লাইন পার হলো আজ। যেতে হয়েছিল ফেলাটে। মাস তো শেষ হলো। নাহ, গেটে ঢুকতেই দেয় নি দারোয়ান। খবর পেয়ে বৌদি উপরের বারান্দা থেকে মুখ বাড়ায়ছিল অবশ্য, ‘না গো আসতে হবে না…।‘ মানে? কিছুক্ষন দম ধরে খাড়ায় ছিল গেটে। নাহ, বৌদি আর এলো না। উপর থেকে বললেও না কিছু। মাস যে পুরে গ্যেছে…তা গেল মাসে সবিতা তো রান্নাই করে নি…।

সন্ধ্যা নামতে না নামতেই কত্ত বড় চাঁদ, একবারে ফকফকা আলো। লাইনগুলা চকচক করছে, যেন মুখ দেখা যায়। চাল, আটা শেষ হতে লেগেছে। সন্তুর বাপ কবে হাতে নিবে খুরপি? মঞ্জুর মা, আলপনা, খোঁড়া বুধার বেটি— সবাই তাকায় এ ওর দিকে। আর মুখের ভাঁজগুলি এই জোছনা আলোতে একবারে পষ্ট।

সবিতা বেশি ভাবতে পারে না। সন্তুটা ভাত দিলেই খুব জেদ করে। রুটি খেতে বড্ড ভালোবাসে ছেলেটা। ঐ…ঐ…রুটিগুলো…লাইনে পড়ে ছিল ছড়িয়ে…চাঁদের আলোর নিচে…

Exit mobile version