পোর্টজিন

এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর জাগরণঃ তৈমুর খান

Bengal Live পোর্টজিনঃ

এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর জাগরণ

তৈমুর খান

হঠাৎ হঠাৎ নিজের ভেতর কোনো এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে জেগে উঠতে দেখি। মানব-খোলসের ভেতর এই প্রাচীন সন্ন্যাসীর জাগরণ আমাকে কিছুটা আলাদা করে দেয়। সারাদিন মৌন থেকেই এক অজাগতিক বিষাদে দিন কেটে যায়। তখন কবিতা লিখি না। অপ্সরার কথা ভাবি না। ঈশ্বরের কথাও মনে আসে না। অথচ এক অস্থির শূন্যতার আলোড়ন অনুভব করি। নিজের সাথে অবশ্য নিজের কথা চলতে থাকে।

আত্মনিরীক্ষণের এই ধারা থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারি না। এই নিরীক্ষীয় বলয়ে বিচরণ করার তাগিদ থেকেই সময়ের অভিমুখে ধাবিত হই। সময়কে জবাবদিহি করতে হয়। কোনো সিদ্ধান্ত নয়, অথচ প্রশ্নের পর প্রশ্ন অতিবাহিত হতে থাকে। আত্মঅনুরণনের ভাষাকে তুলে ধরতে চাই বারবার। তা যদি কবিতা হয় হোক। শিল্প হয় হোক। ইংরেজিতে Mono-Mania বলে একটি শব্দ আছে যার অর্থ একক ভাব বিকার। অনেকটা এরকমই ব্যাপার। এই একক ভাব বিকারের ঘোরে ঘুরপাক খেতে থাকি।

তাহলে পার্থিব মোহ কোথা যায়?

এ প্রশ্ন স্বাভাবিক, কারণ এই জল-মাটি-হাওয়া-আগুনের শরীরে কাম-কামনার দুর্মর অভিপ্রেত বাসা বাঁধবেই। এর আমৃত্যু ব্যত্যয় নেই। কিন্তু এইসব প্রবৃত্তিগত কাম-কামনাতেও এক শূন্যতার অনিঃশেষ বিসর্গ বিরাজ করে। একসময় তা ছায়াবৃত্তের বিমুগ্ধ প্রলেপ হয় আত্মবিস্মরণের পথেও চলে যায়। তখন নিজেকে ছুঁয়ে দেখলে অন্যকে ছোঁয়ারও প্রকাশ ঘটে। আত্মপৃথিবীর বিস্তৃত অন্বয়ে মিশে যায় অনন্ত। তখন ব্যক্তি সীমানার ক্ষুদ্রত্ব নৈর্ব্যক্তিক পর্যায়ের অসীমে পৌছে যায়। একজন মানুষ তখনই মানব। বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর আগমন তখনই সম্ভব, যখন নিজেকে জন্মান্তরের প্রক্ষেপে বারবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

তাহলে আমি কে?

‘আমি’ কথাটির মধ্যেই যে অহমের দেখা মেলে যা অহংকার। নিজেকে তুলে ধরার মধ্যে এই সর্বনামটি প্রচলিত হলেও ‘আমি’ বলে জগতে কাউকেই পাওয়া যায় না। সবই ব্রহ্ম স্বরূপের অংশমাত্র। পার্থিব জীবনের মুদ্রায় কাঙ্ক্ষিত কোনো গোচর ছায়াকেই ‘আমি’ নামে অভিহিত করা যায়। এই ‘আমি’ যে ক্ষণস্থায়ী সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এর কোনো দায়িত্ব নেই তা সকলেই একসময় উপলব্ধি করতে পারেন। সেই কারণেই ‘আমি’ ক্রমশ ধ্বংসশীল এক ধারণা। প্রতিটি সচেতন মানুষ বা শিল্পীর সাধনা তাই আমিকে অতিক্রম করে যাওয়া। আত্মজাগরণের বোধে সকলেই তাঁরা দীপিত হতে চান। রবীন্দ্রনাথের যেমন ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’, তেমনি জীবনানন্দ দাশেরও হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার অবিরাম প্রক্রিয়া সমস্ত কবির মধ্যেই চারিত হয়ে যায়।

তাহলে পার্থিব প্রেমের অভিব্যক্তি কী?

পার্থিবতা থেকে অপার্থিব অনন্তের জাগরণ ঘটে। পার্থিবতা তো নিজেকে মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। গাছ যেমন শিকড় আঁকড়ে ওঠে আকাশে-নিসর্গে এবং সূর্যের আলো-বাতাসে ফুল ও পত্রের ভাষা পায়, ফল ও সুগন্ধের আয়োজন করে, তেমনি পার্থিব উৎস থেকেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর প্রাপ্তি। নির্মোহ, সাবলীল এক জীবনের প্রত্যাক্ষীয় অবলম্বন বলা যেতে পারে। প্রতিটি মুহূর্তই তাই উত্তরণ। সময়ের পর্যটনে এই উত্তরণ থেকেই জীবনের এক প্রাজ্ঞ সমাচার নিরূপিত হয়। পোপ প্রকৃতির এই অনাবিল বিমুগ্ধতায় ঈশ্বরের সামীপ্য অনুধাবন করেই বলেছিলেন:

‘All nature is but art unknown to thee’

নিজের আসনটি খুঁজে পেতে সকলকেই প্রকৃতির কাছে যেতে হয়। বিশ্বভরা প্রাণের আকুতির মাঝে বিস্মিত রবীন্দ্রনাথও অনুধ্যানের মাত্রায় নিজেকে উন্নীত করেছিলেন। শেক্সপিয়ারও জেনেছিলেন : ‘Great creating nature’কে। নারীদেহ, নারী শোভা কিংবা রমণীকাঞ্চন ইন্দ্রিয় আসক্তির রাগরঞ্জিত পর্যায় হলেও তা থেকেই সাধকের প্রেরণা ও শক্তি সঞ্চয় হয়। একসময় সেই রাগও অনন্তের সংরাগে পৌঁছে যায়। তখন আমাদের ভেতরের বৃদ্ধ সন্ন্যাসীও দেখতে পায়:

বেণী দুলছে,বেণী দুলছে

আমাদের ফাঁকা হৃদয়পুর

দূর থেকে দেখছে আলোর নূপুর

অন্নপূর্ণারা চলে যাচ্ছে একে একে

আমরা ঘর বেঁধে সারি সারি

আগলাচ্ছি মৃন্ময় সভ্যতাকে
হৃদয়পুর উজাড় হয়ে যায় বলেই ফাঁকা, শুধু ‘বেণী দোলা’র মরীচিকা জেগে থাকে। যে ‘নূপুর’ একদিন আসক্তির অমোঘ বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিল, তা আলোর ‘নূপুর’ হয়ে যায়। যে ‘আলো’ ঐশ্বরিক বা ব্রহ্ম চেতনার ধারক। ‘অন্নপূর্ণারা’ নারী হয়েও দেবীতে সমন্বিত। ‘ঘর’ আশ্রয়ের জ্ঞাত অবস্থিতি মাত্র। ‘মৃন্ময় সভ্যতা’ শুধু মানবীয় পৃথিবীরই প্রতীক। সেখান থেকেই আমাদের যাবতীয় উত্থান নির্ভর করে এবং বিস্তৃত হয়।

তাহলে কবিতা কি শুধু আত্মজাগরণেরই ভাষা?

প্রকৃত কবিতা তো তাই-ই। দর্শন ছাড়া যেমন কবিতা হয় না, তেমনি সাধন বিনা সিদ্ধিলাভও সম্ভব নয়। উপনিষদে ‘অপাবৃণু’ শব্দটিতে তাই সত্য, জ্ঞান ও জ্যোতির প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। ‘আত্মানামবিদ্ধি’ নিজেকে জানার মধ্যে দিয়েই কবি জগৎ ও জীবনকে জানার সাধনা করে যান। কবিতা সেই জাগরণের ভাষাই।রূপনারায়নের কূলে জেগে ওঠা কবি নিজেকে দেখেন যেমন, সেই সঙ্গে সময় ও জীবনের লীলারংকেও আভাসিত করেন । তাই প্রথম দিনের সূর্য থেকে দিনের শেষ সূর্যের পথ অতিক্রমকে নমস্কার করার মধ্যে দিয়েই নিজ অস্তিত্বের বিস্তৃতির অমোঘ দর্শনকেই নিবেদন করেন। ম্যাথু আর্নল্ড এ কথা ভেবেই একদা বলেছিলেন :

‘poetry is the criticism of life’

এই সমালোচনা যে self-criticism তা বলাই বাহুল্য। এই সমালোচনায় প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসীর দৃষ্টি সর্বদা নিক্ষিপ্ত হয় বলেই এক দার্শনিক প্রজ্ঞাও প্রতিফলিত হতে দেখি। সমালোচক বুচার( Butcher) ইতিহাস এবং কবিতার তুলনামূলক আলোচলায় স্পষ্টভাবে কবিতাকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। তাঁর মতে কবিতা:

‘is a more philosophical and higher thing than history’

দর্শনই শেষ পর্যন্ত আমাদের পথ দেখায়। আমাদের আত্মার ধ্বনিগুচ্ছকে প্রতিধ্বনিত করে। সেই কারণেই কবিতার মধ্যে জেগে ওঠে—আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মঅবমাননা, আত্মসন্তোষ, আত্মসংযম এবং স্ববিরোধীতাও। বহুমুখী কবিতার সঠিক ও সার্থক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা পাল্টে যায়। Self-love থেকে Self-luminous পর্যন্ত সবকিছুর মধ্যেই থাকে কবির Self-made. সর্বদা Self-moving-কেই কবিতায় নিয়ে আসতে চান। তাই কবিতার মধ্যে আত্মজীবনের প্রতিরূপই প্রতিফলিত হয়:

‘Perhaps the self-same song that found a path

Through the sad heart of Ruth.’

কবি কীটস কথিত এই পথেই আত্মপরিষেবার মমতা মাখানো বেদনাবহ আরতিতে আমাদের ভেতরে বৃদ্ধ সন্ন্যাসী সর্বদা জেগে ওঠেন। কথা বলেন।কাঁদেন । হাসেনও। সব কবির সব প্রকৃত কবিতার ক্ষেত্রেই Self-same-কেই দেখতে পাই।

Related News

Back to top button