Archiveরায়গঞ্জ

শতধিক বছরের পুরনো দেবীনগর কালীবাড়ি, জড়িয়ে আছে লৌকিক-অলৌকিক নানান কথা

 

Nblive রায়গঞ্জঃ সময়টা ১৮৬০ কি ১৮৭০। জঙ্গল লাগোয়া শ্মশান,সাথে কালী মন্দির। কার্তিকের অমাবস্যায় ডাকাতেরা ডাকাতিতে যাবার আগে মাকালীকে সন্তুষ্টি করার জন্য পশুবলি সহযোগে পূজা দিয়ে বের হত। সেই চালু হওয়া পূজা এখনও ভক্তি ও নিষ্ঠাসহকারে চলে আসছে রায়গঞ্জের দেবীনগর কালীবাড়িতে। শহরবাসীর বিশ্বাসের সাথে জড়িয়ে থাকা এই মন্দিরের দেবী নাকি ভীষণ জাগ্রত। তাই কালীপূজোর সময় জেলাবাসীর ঢল নামে এই পূজা দেখতে।

যদিও সঠিক কত সাল থেকে এবং কে এই পূজা প্রচলন করেন তা সঠিক জানা না গেলেও তবুও পূজার বয়স শতাধিক। ইতিহাস খুঁজে যা তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে ডাকাতেরা এই পূজা শুরু করার পর দিনাজপুরের জমিদার স্যর গিরিজানাথ রায় বাহাদুর ( যিনি ১৮৮২ – ১৯১৯ পর্যন্ত দিনাজপুরের জমিদার ছিলেন) দিনাজপুর থেকে প্রতি বছর এখানে পূজা দিতে আসতেন। তাঁর মৃত্যুর পর পরবর্তী জমিদার মহারাজা জগদীশ নাথ রায় বাহাদুর,তিনি এই পূজা দেখভাল শুরু করেন। তিনি ফি বছর দিনাজপুর থেকে পুরোহিত, ঢাকি সহ সমস্ত আয়োজন নিয়ে এসে পূজা দিয়ে চলে যেতেন।

 

 

তাঁর মৃত্যুর পর বংশের আর কোন উত্তরাধিকারী না থাকায় ও জমিদারি প্রথা লুপ্ত হলে দিনাজপুরের যারা কর্মচারী ছিলেন তাঁদের কিছু এদেশে চলে আসেন এবং এখানকার সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পান। এদেরই মধ্যে ঊষারঞ্জন মিত্র, সুধীর চ্যাটার্জী সহ মহারাজ কলোনির বাসিন্দাদের নিয়ে জমিদার পরিবার থেকে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। । বর্তমানে এই ট্রাস্টি বোর্ড সেই ট্র‍্যাডিশন মেনে আজও নিষ্ঠাযোগে পূজা চালিয়ে যাচ্ছে।

 

 

 

সেই ট্রাস্টি বোর্ড এখন দেবীনগর কালীবাড়ি ও দুর্গামন্দির সমন্বয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে,জঙ্গলাকীর্ণ এই অঞ্চলে ডাকাতেরা এই পূজার প্রচলন করলেও এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে দিনাজপুরের জমিদারদের স্পর্শে। তাঁদের প্রচলিত নিয়ম- রীতি মেনেই এই পূজা সম্পন্ন হয়। মা কালী এখানে মৃন্ময়ী রুপে পূজিত হন। জমিদার বাড়ির প্রচলিত নিয়ম মেনে কালীপূজার দিন সূর্যাস্তের পর মূর্তি গড়ে, সেই মূর্তিতেই পূজা করে সূর্যোদয়ের আগেই বিসর্জন দেওয়া হয়। এর সাথে পশুবলিও হয়ে থাকে, তবে তা হয় পূজার পরে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন দিনাজপুরের জমিদাররা ছিলেন বৈষ্ণব, তাঁরা বলি দিতেন বা, পশুবলি দিত ডাকাতেরা। তাই সেই ট্র‍্যাডিশন ধরে রাখার জন্য পূজার পরেই বলি দেওয়া হয়। এর সাথে লক্ষণীয় মায়ের মন্দিরে কোন ছাদ নেই। খোলা আকাশের নীচে মায়ের স্থান। শহরবাসীর বিশ্বাস, মন্দির খুব জাগ্রত। একবার ভূপালচন্দ্র রায়চৌধুরির গাড়ি এই মন্দিরের সামনে এসে খারাপ হয়ে পড়ে। তিনি নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলে দেবীর আশিসে গাড়ি ঠিক হয়ে যায়। সাথে দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন মন্দিরের চারপাশে ঘিরে দেবার জন্য। তারপর তিনি মন্দিরের পাশে প্রাচীর তুলে দেন। এই সব ঘটনা এই মন্দিরের ভক্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই পূজার দিন মনোবাসনা পূরণে বহু মানুষের ঢল নামে মন্দিরে।

এই পূজা উপলক্ষ্যে সাতদিন ধরে হয়ে থাকে ঐতিহ্যবাহী উত্তরবঙ্গ ভিত্তিক দীপালি উৎসব। ৭০ এর দশকের গোড়ায় স্থানীয় সুজিতভূষন রায়, নৃপেন চন্দ, সমরেন্দ্রলাল রায়, গোপাল বিশ্বাস প্রমুখ সংস্কৃতিপ্রেমীরা মিলে দেবীনগর বিভাগের ওপর উত্তরবঙ্গ জুড়ে প্রতিযোগীতামূলক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।অঞ্চলের সামগ্রিক উৎকর্ষতার বৃদ্ধিতে এই উৎসবের সূচনা করেন। সংগীত, নৃত্য, কুইজ,ক্রীড়া,সাহিত্যকলা প্রভৃতি বিভাগের ওপর সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

Back to top button