পোর্টজিন

বিনয় মজুমদার নিজের জীবনকেই করেছেন কবিতার বিষয় — নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত

bengal Live portzine

 

“ফিরে এসো,ফিরে এসো,চাকা,
রথ হয়ে,জয় হয়ে,চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।

Bengal Live পোর্টজিনঃ বিনয় মজুমদার বিশ্বের সেই বিরল কবিদের অন্যতম যিনি নিজের জীবনকেই কবিতার বিষয় করে তুলেছেন। একটা গভীর বেদনাবোধ রক্তচোষার মতো কবিকে নিরন্তর শুষেছে, বিনয়ের কবিতা সেই চরম ও পরম শোষণের সাক্ষী হয়ে আছে।এই বেদনা শুধু এক নারীকে না পাওয়ার বেদনা নয়, আসলে তা শিল্পীর চিরবিরহী আত্মার ক্রন্দন।

বিনয়ের কবিতা এক অতিবিখ্যাত কবির উক্তিকেই সপ্রমাণ করে “Our sweetest songs are those that tales of saddest thought”. বেদনাহত বিরহী কবির অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা বোবা বেদনার মধুরতম সঙ্গীত। “ফিরে এসো চাকা” কাব্যগ্রন্থের ৬নং কবিতার শেষ ছয় পংক্তি

“হে আলেখ্য,অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে;
এই যে অমেয় জল—মেঘে মেঘে তনুভূত জল
এর কতটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো?
ফসলের ঋতুতেও অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি।
তবু কি আশ্চর্য দেখো,উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে
তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সঙ্গীতময় হয়।”

মশা উপবিষ্ট হয়,রক্ত শোষণ করে,তবু মশা যখন উড়ে যায় তখন ঈষৎ সঙ্গীত সৃষ্টি হয়।চেনা দৃশ্যাবলীর ভেতর থেকে এই ভাবে কবি আবিষ্কার করেন এক অতিরিক্ত সত্যকে। বিনয় জানেন,

“নিষ্পেষণে ক্রমেক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে
হীরকের জন্ম হয়,দ্যুতিময়,আত্মসমাহিত।”

যে চাকাকে অর্থাৎ চক্রবর্তীকে(গায়ত্রী চক্রবর্তী) বিনয় মজুমদার ফিরে পেতে চেয়েছিলেন,যাকে ঘিরে প্রতিদিন একটি করে কবিতা লিখতেন ও শোনাতেন, কলকাতার বিখ্যাত এক ব্যারিস্টারের অতীব সুন্দরী আদরের দুলালি সেই মেয়েটি উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকায় গিয়ে এক আমেরিকান অধ্যাপককে বিয়ে করে বিনয়ের বুকে যে শেল হেনেছিলেন তিনি কখন যেন তাঁর কাব্যের মানসপ্রতিমা হয়ে উঠেছেন। ‘ফিরে এসো চাকা’ কাব্যগ্রন্থের ৭০ সংখ্যক কবিতায় তাই কবি লিখেছেন,

“ফিরে এসো,ফিরে এসো,চাকা,
রথ হয়ে,জয় হয়ে,চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।

আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে। ”
‘ফিরে এসো চাকা’য় মোট ৭৭টি কবিতা আছে।কবিতাগুলি কালানুক্রমে দিনপঞ্জিরূপে লেখা হয়েছে। প্রত্যেকটি কবিতা স্বয়ংসম্পূর্ণ অথচ পরস্পর সম্পর্কিত। ফলত কবিতাগুলি একযোগে একখানি পূর্ণাঙ্গ কাব্য হয়ে উঠতে পেরেছে।বিনয় নিজেই এই কাব্যগ্রন্থখানিকে ”বান্ধবকেন্দ্রিক শুধুমাত্র প্রেমার্তির কাব্য” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই প্রেম ও প্রেমের বঞ্চনা কবির হৃদয়কে শুধু নয়, তাঁর মস্তিষ্ককেও আক্রান্ত করে তুলেছে। তাই তাঁর স্থান হয়েছে কখনও জেলখানা, কখনো হাসপাতাল, কখনোবা পাগলাগারদে।

বিনয় মজুমদার ঠিক পাগল ছিলেন না,ছিলেন কাব্যোন্মাদ,আত্মভোলা এক শিশু এবং সাধক।১৯৬১ সালের ২৩ জুলাই যে কবিতাটি রচনার পরে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন সেটি এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য :

“তিন পা পেছনে হেঁটে পদাহত হয়ে ফিরে আসি।
আবার তোমার কথা মনে আসে; ধূমকেতুর মতো
দীর্ঘকাল মনে রবে তোমাকে;পূর্ণাঙ্গ জীবনের
জটিলতা,প্রতিঘাত বালকের মতোন সাগ্রহে
ভালোবাসি; হৃদয়ের গুরুভার জলে নিমজ্জিত
অবস্থায় লঘু ক’রে নেবার পিচ্ছিল সাধ ক’রে
পদাহত হয়ে ফিরি;অজ্ঞাত পূর্ণাঙ্গ জীবনের
জটিলতা, প্রতিঘাত বালকের মতো ভালোবাসি।”
(২৬ সংখ্যক,ফিরে এসো চাকা)

দীর্ঘ ছ’মাস পরে (১৯৬২ সালের ২৭ জানুয়ারি) হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তিনি লেখেন,

“মুক্ত বলে মনে হয়; হে অদৃশ্য তারকা,দেখেছো
কারাগারে দীর্ঘকাল কীভাবে অতিবাহিত হলো!
অথচ বাতাস ছিল;আবদ্ধ বৃক্ষের পাতাগুলি
ভাষাহীন শব্দে,ছন্দে এতকাল আন্দোলিত ছিলো।
অদৃশ্য তারকা,আজ মুক্ত বলে মনে হয়; ভাবি,
বালিশে সুন্দর কিছু ফুল তোলা নিয়ে এত ক্লেশ।
ইতিমধ্যে কতিপয় অতি অল্প পরিচিত,নীল
নীল নয়,মনে হয়,নীলাভ কচুরিফুল মৃত।
অদর্শনে মরে গেছে; অন্ধকার, ক্ষুব্ধ অন্ধকার।
জীবনে ব্যর্থতা থাকে;অশ্রুপূর্ণ মেঘমালা থাকে;
বেদনাতল মোরগের নিদ্রাহীন জীবন ফুরালো।
মশাগুলি কি নিঃসঙ্গ, তবুও বিষণ্ণ আশা নিয়ে
আর কোনো ফুল নয়,রৌদ্রতপ্ত সূর্যমুখী নয়,
তপ্ত সমাহিত মাংস,রক্তের সন্ধানে ঘুরে ফেরে।”
(ঐ ২৭ সংখ্যক কবিতা)

এই গভীর জীবনবোধ কি কোনো পাগলের কাছে প্রত্যাশিত?’জ্ঞান’ এখানে এক নিশ্চুপ আর্তনাদ। আর উপমা! সে যেন দৃশ্য থেকে সত্য ছিঁড়ে আনবার নগ্নতা।তারও আগে ৬ নং কবিতায় এক নগ্ন সত্যকে উদ্ঘাটন করে কবি লিখেছিলেন,

“সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।”

কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিনয় মজুমদার একদা বলেছিলেন, “কবিতার একটি প্রধান শর্ত হল বাক্যটিকে অবিস্মরণীয় হতে হবে; একবার শুনলেই যাতে তাকে আর ভোলা না যায়।”বিনয়ের কবিতায় এমন অসংখ্য বাক্য রয়েছে যা অবিস্মরণীয়। কিছু উদাহরণ দেবার লোভ সামলানো গেল না।

১)বিপন্ন মরাল ওড়ে,অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে-পাহাড়ে।

২)মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।

৩)আকাশ আশ্রয়ী জল বিস্তৃত মুক্তির স্বাদ পায়,

৪)স্রোতপৃষ্ঠে চূর্ণ -চূর্ণ লোহিত সূর্যাস্ত ভেসে আছে;

৫)কেবল নির্ভুল ভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না এখনো।

৬) শয়নভঙ্গীর মতো স্বাভাবিক, সহজ জীবন
পেতে হলে ঘ্রাণ নাও,হৃদয়ের অন্তর্গত ঘ্রাণ।

এই পংক্তিগুলি আমি উদ্ধৃত করলাম তার কারণ হাবরায় (উত্তর চব্বিশ পরগণা)

আমার প্রথম দৌহিত্র শ্রীমান সাগ্নিক নন্দীর জন্মদিনে আমন্ত্রিত এক ব্যক্তির হাতে “ফিরে এসো চাকা” বইখানি দেখে চেয়ে নিয়ে পড়েছিলাম এবং অচেনা অতিথির ভোজন পর্বের ফাঁকে ভালোলাগা কয়েকটি পংক্তি সেদিনের খবরের কাগজের সাদা অংশে টুকে নিয়েছিলাম । এর মাত্র কিছুদিন আগে কবি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার(২০০৫)ও ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (২০০৫)লাভ করেন।আমার আগ্রহের এটিও অন্যতম কারণ।

১৯৫৮ সালে প্রকাশিত “নক্ষত্রের আলোয়” কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি পাঠ করে আমার মতো অতি সাধারণ পাঠকের মনে হতেই পারে যে বিনয় মজুমদার জীবনানন্দের অনুসারী কবি। বিশেষত চিত্রকল্প ও কাব্যদেহ নির্মাণের ক্ষেত্রে।কয়েকটি উদাহরণ :-

১)তুমি যেন চলে যাও অতি দূর, অমলিন নক্ষত্রের নীলে ;
আমি যেন ধীর,হিম,বিশাল প্রান্তরে বসে বসে
সমুদ্রের কথা ভাবি,অনুভব করি তুমি কত কাছে ছিলে। (চিরদিন একা একা)

২)চাঁদ নেই, জ্যোৎস্নার অমলিন জ্বালা নেই,তবু
কী এক বিপন্ন আলো লেগে আছে এ-মাঠের আঁধারের মুখে। (নক্ষত্রের আলোয়)

৩)অন্ধকারে পৃথিবীর ম্লান সব ছায়ারূপ দেখে
বহুদিন কেটেছিল আলোকের আকঙ্ক্ষায় থেকে।

বিনয় মজুমদারের মতে বাংলা শুধু বিশ্বভাষা নয়,তা মহাবিশ্বেরও ভাষা,

“তবে পৃথিবীর লোকে সকলেই বাংলা বোঝে,বিশ্বের সকল
তারার অধিবাসীরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলে।”(পৃথিবীতে)

বিনয়ের মতে পৃথিবীও একটি তারা।তিনি এই তারায় থাকেন না।থাকেন অশ্বিনীতারার শিমুলপুর গ্রামে।সেখান থেকে তিনি মাঝে মাঝে পৃথিবীতে যান।এসব থেকে বোঝা যায়,অশ্বিনীতারা হচ্ছে বিনয় মজুমদারের একান্ত নিজস্ব ভুবন। তাঁর কণ্ঠে যেন রবীন্দ্রনাথের প্রতিধ্বনি,

“আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে অমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান। “

বিনয়ের তাবৎ কাব্যসৃষ্টির মূলে রয়েছে এই বিস্ময়বোধ।এই মহাবিশ্ববোধের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রেখে বিস্ময়াবিষ্ট কবি বিনয় মজুমদার একা একা কথা বলে গোটা একটা জীবন কাটিয়ে গেলেন।

Related News

Back to top button