পাখিদের সুরক্ষায় গুপ্তচর বাহিনী

ওয়েব ডেস্কঃ উত্তর দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম মারনাই। গ্রামের প্রবীন বাসিন্দা অক্ষয় পাল একজন অবসর প্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক। পাখি ভালোবাসেন। পাখিদের প্রতি তাঁর পাগলপারা প্রেম নিঃশব্দ আন্দোলন ঘটিয়ে দিয়েছে উত্তর দিনাজপুরের এই প্রত্যন্ত গ্রামটিতে। একটা সময় ছিল, গাছের ডালে পাখি বসলে গ্রামবাসীরা তাড়িয়ে দিতেন। এখন তারা পাখি পাহারা দেন। চোরা শিকারী হানা দিলে রুখে দাঁড়ান। পাখিদের সুরক্ষায় মাষ্টারমশাই গ্রামের কচিকাঁচাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন খুদে গুপ্তচর বাহিনী। চোরা শিকারীদের রুখতে তৈরি করেছেন মহিলা ব্রিগেডও। অক্ষয়বাবুর একক প্রচেষ্টায় পাখিরা খুঁজে পেয়েছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়। গ্রামে গেলেই দেখা মিলবে ঝুঁটিওয়ালা বক, পানকৌরি, সারস, নাইট হেরন সহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশী ও পরিযায়ী পাখির।
শুরুটা হয়েছিল প্রায় একদশক আগে একটি-দুটি করে বক, পানকৌরি বাসা বাঁধতে শুরু করে দুই একটি গাছে। ধীরেধীরে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। বক, পানকৌরি,সারসের পাশাপাশি আসতে শুরু করে নাইট হেরন, ওপেনবিল স্টর্ক প্রভৃতি পরিযায়ী পাখি। মাঠে-ঘাটে, গৃহস্থের উঠোনে বাড়ির পেছনের আম,জাম, কাঠাল, হিজল ইত্যাদি গাছে বাসা বাঁধে ওরা। গ্রামের প্রায় ৩০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে তাদের বসবাস। বৈশাখের মাঝামাঝি সময় থেকে আনাগোনা শুরু হয় এবং শ্রাবনের শেষ পর্যন্ত থাকে। প্রজননের পর ছানারা ডানা মেলে উড়তে শিখলেই গ্রাম থেকে বিদায় নেবার পালা শুরু হয়।
অক্ষয়বাবু বলেন, “পাখিরা আমাদের বন্ধু। পরিবেশ রক্ষার্থে ওদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য। এই কথাটা গ্রামের মানুষগুলিকে বোঝাতে পেরেছি। কিন্তু বাইরে থেকে পাখি শিকারীরা মাঝেমধ্যেই হানা দেয় গ্রামে । পাখিদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ওরা। তাই চোরা শিকারীদের রুখতে বাচ্চাদের নিয়ে একটা টিম গড়ে তুলেছি। দলের খুদে সদস্যরা বহিরাগত কাওকে সন্দেহ জনক ভাবে গ্রামে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই গোয়েন্দার মতন এসে খবর দেয়। এরপর আমি অবস্থা বুঝে ব্যবস্তা নিয়ে ফেলি। গ্রামের মহিলারাও পাখিদের সুরক্ষায় সদা সতর্ক নজর রাখেন”।
প্রথমে পাখিদের উতপাতে বিরক্ত হতেন গ্রামবাসীরা। ঘরবাড়ি নোংরা হওয়ায় মহিলারা সকাল-সন্ধ্যা গালমন্দ করতেন পাখিদের।কিন্তু তাঁদের সেই চিন্তাভাবনা আমুল পাল্টে দিয়েছেন অক্ষয় বাবু। পাখি পড়ার মত করেই গ্রামবাসীদের বুঝিয়েছেন পাখিদের উপকারিতা। সচেতনতা গড়ে তুলতে পোষ্টার সেঁটেছেন গ্রামে। এখন গ্রামের মেয়ে-বউরা বলেন ‘ ছেঁড়া পালক আর খড়কাঠিতে বাড়ির উঠোন নোংরা হয়ে থাকত বলে আগে আমরা বিরক্ত হতাম। বিষ্ঠা ও পাখিদের গায়ের আশটে গন্ধে টিকতে পারতাম না। কিন্তু মাষ্টারমশাই আমাদের মানসিকতা পাল্টে দিয়েছেন। এই অতিথিদের আমরা এখন ভালোবেসে ফেলেছি’।
পাখি প্রেমে মজেছে গ্রামের খুদে শিশু-কিশোররাও। গুপ্তচর বাহিনীর সদস্য ঝুম্পা, বাপন, লীলা, মৃত্যুঞ্জয়, সন্তোষদের এখন বনবাদাড়ে ঘুরে পাখিদেখেই কেটে যায় ছুটির দুপুর। সঙ্গে চলে সতর্ক নজরদারী। সচেতন হয়েছেন গ্রামের কৃষকরাও। তাঁরা বলেন ‘মাস্টারমশাই আমাদের বুঝিয়েছেন পাখিরা কত উপকারি। ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে ওরা আমাদের সাহায্য করছে। সেই কারনে আমরা ওদের আর তাড়িয়ে দিই না। বরং পাহার দিয়ে চোরা শিকারীদের হাত থেকে ওদের রক্ষ করি’।