পোর্টজিন

ঝিঙে ফুল – নয়ন মালিক

Bengal Live পোর্টজিনঃ পোর্টজিন কি? পোর্টজিন একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহের রবিবার এটি বেঙ্গল লাইভের (bengallive.in) এর পোর্টজিন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়।

nayan malik bangla golpo portzine

তখন পড়ন্ত বিকেল ‌। সূর্য মাথা নত করে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। তার নমনীয় আলোয় বিভোর গোটা বিকেলের পরিবেশ। বিকেলের মায়া মোহ পরিবেশে অপরূপ আনন্দে মেতে ওঠে শস্য-শ্যামলা ধরিত্রী। গবা বিকেলের শান্ত পরিবেশে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে তার ক্ষেতের দিকে। এবার মাঠের সেরা তার সবজি। বিশেষ করে ঝিঙে ক্ষেতের তুলনাই হয় না। এমন ঝিঙে ক্ষেত, এই অঞ্চলে আর দুটি নেই। ঝিঙে ফুলগুলো হলুদ হলুদ মুখে কি অপূর্ব ভাবে হেসে থাকে। সে দিকে তাকালে গবার আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। এক অপূর্ব সুখ সারা শরীর জুড়ে মোহাচ্ছন্ন করে ।
গ্রামে সবার মুখে এক কথা, এবার গবার ক্ষেতের তুলনাই হয়না । গবার মত সবজি চাষি বিরল ।
আর হবে নাই বা কেন ! এই সবজির উপর সারা বছরের তার সংসার নির্ভর করছে। তাছাড়া কি অনন্ত পরিশ্রম । সারাক্ষণ ক্ষেতে মাটি কামড়ে পড়ে আছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্ষেতেই তার সময় কাটে। তাদের পরিচর্যা করতে করতে কখন যে সময় পেরিয়ে যায় খেয়াল থাকে না তার।
এমন নিষ্ঠুর পরিশ্রম এই অঞ্চলে আর কজনই বা পারবে।
গবার নিজের এক কাঠাও জমি নেই । সব ভাগে চাষ। গ্রামের মস্ত জমিদার রজত বাঁড়ুজ্জ্যে , তারই জমি ভাগে করে ।
এই পড়ন্ত বিকেলে গবা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার ক্ষেতের দিকে । ঝিঙে ফুলের দিকে তাকালে আর চোখ আনন্দে মেতে ওঠে। প্রজাপতির ডানায় ভর করে ফুলে ফুলে চুমু খেয়ে আসে। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না।
কিন্তু উপায় নেই । বেলা পড়ে আসছে, বাড়ি ফিরতে হবে । নাহলে মা মরা মেয়ে বামির কাছে বকুনি ।
গবা আর একবার মায়া মোহ দৃষ্টিতে ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে , আসতে আসতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
— কে যায় গবা নাকি?
— হ্যাঁ মাস্টার ।
— এত অবেলায়…. কোথায় গিয়েছিলে ..?
— একটু মাঠে।
— তা, শুনলাম তোমার ক্ষেতের ফসল নাকি এবার মাঠের সেরা।
— ওই আর কি ।আপনাদের আশীর্বাদে।
–তা বেশ…তা বেশ। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও গবা , তোমার মেয়ে তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। আমায় বললে আপনি তো ওই দিক দিয়ে যাবেন বাবার সঙ্গে দেখা হলে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে বলবেন।
— আচ্ছা মাস্টার,.. তবে চলি ।
গবা এবার জোরে জোরে চালায় । তাকে এখনি বাড়ি পৌঁছাতে হবে । নাহলে বামির কাছে বকুনি খেতে হবে । হয়তো রেগে সাড়াও দেবে না ।
গবা গ্রামের রাস্তা ধরে যখন বাড়ি পৌঁছালো।তখন বামি সন্ধ্যে দেখিয়ে ঘরে ফিরছে। গবা এগিয়ে গিয়ে ধারিতে বসলো। বামি সন্ধ্যে দেখানো আলোটা ঠাকুরের সামনে নামিয়ে রেখে, ঘর থেকে বলে উঠে
— এত দেরি করলে যে বাবা ?
— একটু হয়ে গেল মা।
— তোমাকে কতবার বলেছি ,সন্ধ্যের আগে ঘরে ফিরবে।
— আজ ক্ষেতে জল করছিলাম তাই একটু….. আচ্ছা মা , এক গ্লাস এক গ্লাস জল দে তো ।
বামি ঠাকুরের সামনে গড় হয়ে প্রণাম করে বাইরে বেরিয়ে এল । পাশের ঘর থেকে এক বাটি গুড় আর এক ঘটি জল এনে বাবার সামনে নামিয়ে দিল।
— এখন আবার গুড় দিতে গেলি কেন ?
— খাও তো , কখন দুপুরবেলায় দুটি খেয়ে বেরিয়েছো । বলি সারাদিন ক্ষেতে পড়ে থাকলেই হবে । শরীরটা নজর দিতে হবে না ?
— কেন রে মা– শরীরের আবার কি হলো !
— বলি , অত খাটলে শরীর কি ভালো থাকবে।
— না রে মা , খাটলে গতর ক্ষয়ে যায় না।
— আচ্ছা … খাও তো . .তোমার সঙ্গে কথায় পারবো না।
গবা ঘটি থেকে একটু জল নিয়ে ডান হাতটা ধুয়ে নিল । তারপর বাটির সমস্ত গুড় আর এক ঘটি জল এক নিমেষে শেষ করে ফেলল ‌।
— বামি ঘরের এক কোণে চিমনির কাঁচ মুছছিল। সেখান থেকে বলে ওঠে—
— বাবা।
— কি রে মা ?
— আজ রজতবাবু এসেছিল ।
— কখন ?
— এই , একটু আগে । তোমায় খুঁজছিল।
— শালাটা , আবার কি করতে এসেছিল !
— তা জানি না । তোমায় দেখা করতে বলেছে।
— শালা আবার কি মতলব এঁটেছে !
— আচ্ছা বাবা …
— কি মা ?
— রজতবাবুর টাকাটা শোধ হয়নি।
— না ..রে । ফসলটা তুলেই ওর সব পাওনা মিটিয়ে দেব ।
গবা ধড়ি থেকে উঠে পরনের কাপড় ঠিক করে নিল।
— একি ..! আবার উঠলে যে ?
— দেখি শালার ঘর থেকে একবার ঘুরে আসি।
— সে না হয় কাল যাবে, আজ এতটা সন্ধ্যে হয়ে গেল ।
— না রে মা, ঘুরে আসি, শয়তানটা কি মতলব এঁটেছে না জানা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাব না। রাতে ঘুমও হবে না।
আমি চিনিটা ধরিয়ে বাবার কাছে নিয়ে এল।
— বেশ , দেখ বেশি তর্কাতর্কি করো না। আর হ্যাঁ, এই চিমনিটা হাতে করে নিয়ে যাও।
গবা মেয়ের কথামতো চিমনিটা বাঁ হাতে নিয়ে, নিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। বামি নাছ দরজা পর্যন্ত বাবার পিছুপিছু গেল ।
— দেখ , বেশি রাত করোনা না ।
— না রে মা, রাত করব না। তুই ঘরের ভিতর যা ।
বামি নাছ দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকে । যতক্ষণ বাবাকে দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে।
গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যা । এখনো সন্ধ্যা তার কালো সাম্রাজ্য ভালো করে বিস্তার করে নি । চিমনির আলোয় চেনা পথে চলতে অসুবিধা হয় না। আগে আগে কয়েকটা ছেলে মেয়ে গল্প করতে করতে চলেছে , বিপিন মাস্টারের বাড়ি পড়তে । হাতে তাদের রাতের অতিথি। ফিরবে সেই রাত নটায় । গবা পথ চলতে চলতে ভাবে শয়তানটা কি জন্য দেখা করতে বলেছে কে জানে, নিশ্চয়ই বকেয়া টাকার কথা বলবে , এমাসে টাকাটা শোধ দেবার কথা । যদি তাই বলে , তবে ফসল তোলার পরই টাকাটা শোধ দেবে ‌। মানবে কি না জানা নেই। যদি না মানে ! পাঁচ -ছশো টাকা জোগাড় করবে কি করে । বউয়ের যা গয়না বাকি ছিল তাও স্যাকরার দোকানে বন্ধক। চাষের জন্য টাকা নিয়েছে । এখন উপায় ! এ মাসের মধ্যে টাকা শোধ করার কোন উপায় নেই। দু মাস সময় দিলে ঝিঙে বিক্রি করে না হয়ত দেওয়া যাবে‌।
— গবা যে ! এদিকে কোথায় ?
হঠাৎ মাধব জ্যাঠার কথায় গবার ভাবনার বিচ্যুতি ঘটলো । সামনে তাকিয়ে দেখে মাধব জ্যাঠা গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছে।
— বাবুদের বাড়ি ।
–এই, অসময়ে !
— হ্যাঁ …হ্যাঁ.. ।
— বেশ.. বেশ , ফসল তো ভালই ফলিয়েছো ?
— ওই আর কি।
মাধব জ্যাঠা আর দাঁড়ালো না । গরুর পিছু বাড়ির অভিমুখে রওনা হলো । গবা একবার পিছন ফিরে জ্যাঠার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে হাঁটা দিলো । এবার তার ফসলের তারিফ সারা গ্রাম জুড়ে। সবার মুখেই এক কথা। শুনতে বেশ লাগে। ঐ ফসল তো সে নিজের সন্তানের মত লালন-পালন করে ।
গবা যখন বাবুদের বাড়ি পৌঁছালে , তখন অন্ধকার আর কালো সাম্রাজ্যের জাল বিস্তার করে নেমে পড়েছে তাদের গ্রামে। তবু বাবুদের বাড়িতে তা বুঝার উপায় নেই । বিজলির কৃত্রিম আলোয় মহলটা নেয়ে উঠেছে রুপালি ডালিতে।
মহলের প্রতিটি কোনায় কোনায় বেরিয়ে আসছে তার রুপালি ছটা। গ্রামটাকে বিদ্রূপ করে অপূর্ব মায়াবী হাসি হাসছে তার শুভ্র ধবল দাঁতে।
মহলের শুভ্র আলোয় গবার চোখটা প্রথমে ধাঁধিয়ে গিয়েছিল । সেটা ঠিক হতেই গবা এগিয়ে গেল বৈঠকখানার দিকে । রজত বাবু তখন বৈঠকখানাতেই আসর বসিয়েছিলেন । গবা এগিয়ে গিয়ে রজতবাবুকে নমস্কার করে বললে–
— আমায় ডেকেছিলেন কর্তা ?
–হ্যাঁ ..বলছি …আমার টাকাটা এই মাসের মধ্যে শোধ দেওয়ার কথা , সে কথা কি তোমার খেয়াল নেই । মাস তো প্রায় শেষ হতে চলেছে ।
— আর দুটো মাস সময় দেন কর্তা ‌।
— এখনো দুটো মাস ! অসম্ভব.., এ মাসের মধ্যেই বকেয়া ঋণ শোধ করতে হবে।
গবা হাত জোর করে অনুনয় করে বললে
— দয়া করে কর্তা আর দুটো মাস সময় দিন। ফসল উঠে গেলেই সব ঋণ শোধ করে দেব ।
— না ..হে , অনেক সময় দিয়েছি আর সময় দেওয়া যাবে না। তুমি এ মাসের মধ্যে টাকাটা শোধ দিতে পারবে কিনা তাই বলো?
— আপনি যদি দয়া না করেন কর্তা —-
–বটে !—কাল থেকে তোমার ক্ষেত আমার লোকেরা পাহারা দেবে । যদি এ মাসের মধ্যে টাকাটা শোধ দিতে পারো ক্ষেতের ফসল তুমি পাবে। নচেৎ এতে তোমার কোন অধিকার নেই।
— কর্তা !…
— চিৎকার করো না । আমি যা বললাম এই আমার শেষ কথা ।
— এ অন্যায় কর্তা ।
— তোমার কাছে কি আমায় ন্যায়-অন্যায় শিখতে হবে ।
–কিন্তু ঝিঙে ক্ষেত আমি আমার বুকের রক্ত ঝরিয়ে চাষ করেছি, ওটা নিলে আমরা না খেতে পেয়ে মরব কর্তা।
— ওসব চালাকি শুনছি না । ক্ষেত আমার, কাল সকাল থেকে আমার লোকেরা ওটা পাহারা দেবে। তুমি এখন বাড়ি যাও । আমার আহার সারা হয়নি।
গবা চিমনিটা হাতে নিয়ে বৈঠক খানা থেকে বেরিয়ে, গভীর অন্ধকারের মধ্যে সাঁতার কাটে। চিমনিটা হাতে থাকায় ভয়ঙ্কর অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে পারছে না, কিন্তু রজতবাবু আজ তাকে ভয়ংকর ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জর্জরিত শরে গ্রাস করেছে । আর পরিত্রাণ নেই । নিমেষে গিলে খাবে তার সংসার । মাথাটা বড় টিস টিস করছে তার। বুকের ভিতরটা যন্ত্রণায় ব্যথায় মোচড় দিয়ে ওঠে। কাল থেকে ক্ষেত আর তার থাকবে না। কোন অধিকারই থাকবেনা ক্ষেতের। রজত বাবুর জমি ভাগে করার কি পরিণাম আজ নিজের চোখে দেখল । এত বড় অন্যায় । তবু কিছুই করতে পারবে না । কিছুই না । গ্রামের কেউ তার হয়ে মাথা দেবে না । সবাই জানে রজতবাবুর বিরুদ্ধে যাওয়ার পরিণাম কী ভয়ঙ্কর ।
গ্রামের রাস্তাটা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জনাপ্রাণী নেই । শ্মশানের নীরবতা বিরাজ করেছে গ্রামজুড়ে। গবা অন্ধকারে চিমনির স্বল্প আলোয় সাঁতার কাটতে কাটতে ক্লান্ত লঘু পায়ে বাড়ি ফিরে এলো ।
–বামি ?
— বাবা ।
বামি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
— এত দেরি হল যে, বাবা ?
গবা এগিয়ে গিয়ে চিমনিটা ধারির এক প্রান্তে নামিয়ে রাখল। নিজেও খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়ল শান্ত হয়ে। চোখ দুটো তার মুদ্রিত । যেন গভীরভাবে ধ্যানে মগ্ন ।
–বাবা !
কোন উত্তর নেই। তার দুটি চোখ মুদ্রিত রইল।
— বাবা, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
গবা আস্তে আস্তে চোখ দুটো উন্মোচিত করল। তার মুখে বেদনায় থমথম করছে। বামির চোখে তা এড়ালো না । গবার মুখ থেকে আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এলো—-
— সব শেষ হয়ে গেল মা!
সহসা বামির চোখ বিদ্যুৎচমকের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো। একরাশ উদগ্রীব নিয়ে বললে
–ও কথা বলছো কেন ? কি…কি হয়েছে বাবা। রজত বাবু কি বললেন ?
— সব শেষ হয়ে গেল রে। টাকা শোধ দিতে পারেনি কাল থেকে ক্ষেত রজত বাবু অধিকার করে নেবে।
— একি ..বলছো ?
— হ্যাঁ …রে মা। আমাদের একেবারে নিঃস্ব করে দিলো রে, একেবারে নিঃস্ব।
— তা হয়না ..বাবা । এ অন্যায়। টাকার জন্য কি আমাদের ক্ষেত ওরা অন্যায় ভাবে দখল করে নেবে। গ্রামে মানুষ নেই বাবা।
— কে আমাদের হয়ে মাথা দেবে, মা । কেউ না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারায় ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ন কন্ঠে বলে ওঠে….
— জানিস মা আমি যখন ক্ষেতে যাই তখন ঝিঙে গাছগুলো আমায় দেখে কি খুশি না হয় । হেলেদুলে আমার গায়ে পড়তে চাই । ঝিঙে ফুলগুলো আমায় দেখে হলুদ হলুদ মুখে অপরূপ ভাবে হেসে ওঠে । বাতাসে সুগন্ধ ছড়িয়ে তারা কত গল্প করে আমার সঙ্গে। যখন আমি আলতো ভাবে ওদের গায়ে হাত দেই তখন আমার শরীরে এক অপূর্ব আনন্দের শিহরণ বয়ে যায়। কি যে ভালো লাগে তখন, বলে বোঝানো যাবে না।
চিন্তায় চিন্তায় অনেক রাত পর্যন্ত গবার চোখের পাতা একেবারে জন্যেও নেমে এলো না। যদিও মধ্যরাতে ঘুমপরী একটু কৃপা করেছিল , তাও ভোরের দিকে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেল গবার । সাংঘাতিক নির্মম স্বপ্ন । ভাবলে রুদ্ধশ্বাস হয়ে আসে নিঃশ্বাস । একটা ভয়ঙ্কর দানব হাতির মতো পা দিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার ঝিঙে ক্ষেতে। আর তার ভীমাকৃতি হাতে ঝিঙে ফুল ডোলে পিষে একাকার করে দিচ্ছে ।
না, গবা আর সহ্য করতে পারেনি । মনে হচ্ছে কেউ তার বুকের ওপর বিশাল পদভারে বসে রক্ত চুষে খাচ্ছে । ভীষণ জোরে আর্তনাদ করে ওঠে গবা, তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল তার ।
গবা ঠিক করে ফেলে ঝিঙে ক্ষেত কিছুতেই পরের হাতে ছাড়বেনা। কিছুতেই না। ঝিঙে ক্ষেত তার জীবন। ক্ষেত না থাকলে কিছুতেই সে বাঁচতে পারবে না‌। বুকের রক্ত দিয়ে এ ক্ষেত সে আগলাবে। বাবুদের অন্যায় আচরণ কিছুতেই সে মেনে নেবে না ।
তখন পুরোপুরি সকাল হয়নি। অন্ধকার তার হালকা কালো আবরণটা একটু একটু ঘুচাতে ব্যস্ত। পূর্ব আকাশ আস্তে আস্তে সিঁদুর বর্ণ ধারণ করেছে। গবা নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল । ক্ষেতে গিয়ে গবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সকালের নির্মল বাতাস ঝিঙে ফুলের গন্ধে মাতিয়ে রেখেছে সারা মাঠ। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল গবা। সকালে সূর্যের সোনালি আলো পড়তেই আলোর বন্যা বয়ে যায় ক্ষেতজুড়ে । ঝিঙে ফুলগুলো একগাল হাসি নিয়ে চেয়ে থাকে তার দিকে। কি অপূর্ব, কি ভালোবাসা মাখানো মধুর সেই দৃষ্টি । এই হাসি কিছুতেই কসাইয়ের ছুরিতে হত্যা হতে দেবে না ।
একটু বেলার পর কর্তাবাবুর দুজন লেঠেলকে ক্ষেতের দিকে আসতে দেখে সচেষ্ট হয়ে গেল গবা। তার মাথায় খুন চেপে বসে । দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করে তাদের জন্য।
–গবা আজ থেকে এই ক্ষেত কর্তাবাবুর। তুই চলে যা এখান থেকে‌।
— না আমি যাব না , এই ক্ষেত আমার। এই ফসল আমার ।
— গবা এখনো ভালোই ভালোই বলছি চলে যা। আমরা কর্তাবাবুর হুকুম এখানে এসেছি ।
গবা হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে …
— না , এই ক্ষেত আমার। আর কোন রাক্ষসকে আমি এ ক্ষেত অধিকার করতে দেব না ।
— কি বললি !
— হ্যাঁ ..ঠিকই বলেছি , যা তোদের কর্তা কে বলগা।
— গবা ভালো চাস তো সরে যা ,নইলে …
–নইলে কি..?
— তবে রে…
দুজন লেঠেল তেরে গিয়ে আক্রমণ করল গবাকে। তার গায়ে কয়েক ঘা পড়তেই হিংস্র হয়ে উঠলো গবা। গবা মরিয়া হয়ে একজনের লাঠি ছিনিয়ে নিয়ে বিদ্যুতের গতিতে অপরজনকে ঘায়েল করে বসলো । ঠিক সেইসময় অপরজন গবার মাথায় বসিয়ে দিল লাঠির বিষম এক আঘাত । গবা একটা যন্ত্রণাত্মক আওয়াজ করে মুখ থুবরে পড়ে গেল ঝিঙে ক্ষেতে। ক্ষেতের এক প্রান্ত রক্তস্রোতে গেল ভেসে।
বামির কাছে খবরটা পৌঁছাতে দেরি হয়নি । কিন্তু সে যখন এসে পৌঁছাল তখন সবশেষ । বাবা ক্ষেতের একপ্রান্তে রক্তস্নানে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বাবার এই অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল সে। বাবার রক্তাক্ত শরীরটা আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল । গ্রামের কয়েকজন ধরা ধরি করে বাবাকে নিয়ে এলো ঘরে। তখন সে জ্ঞান হারিয়েছে। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার বেনীমাধব পরীক্ষা করে বললে…
— অবস্থা ভালো নয় , সদর হাসপাতালে পাঠাতে পারলে ভালো হতো ।
বামি একা , তাছাড়া সদর হাসপাতালে পাঠানোর মতো টাকাও নেই বাড়িতে। বামি বেণীমাধবের হাতে-পায়ে ধরে বললে—
— আপনি যেমন করে হোক আমার বাবাকে বাঁচান ডাক্তার বাবু ,আমার বাবা কে বাঁচান।
বিকেলের দিকে অবস্থার আরো অবনতি হল। জ্ঞান হবার পর থেকে কেবল ভুল বকে যাচ্ছে।
— বামি দেখ , ঝিঙে ক্ষেতটা কেমন লাকলক করছে , ঝিঙেফুল কত খুশি — হলুদ পাখা মেলে উড়ে চলেছে ,–হলুদ.. হলুদ …রক্তে লাল হয়ে গেছে ঝিঙেফুল । ঝিঙে ফুল লাল হয়ে যাচ্ছে,… ঐতো ঝিঙেফুল …পালিয়ে যাচ্ছে…. উড়ে চলে যাচ্ছে… ঝিঙে ফুল— ঝিঙে ফুল …আমি যাব দাড়াও…. দাড়াও … একি গোটা ক্ষেত ফাঁকা… ঝিঙেফুল নেই …বামি….বামি…
বাবার পাগলামি দেখে বামির বুকটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছিল । সে সে আদ্র সিক্ত কন্ঠে বললে
— বাবা আমি তোমার কাছেই আছি , বলো কি বলবে,
–ঐ দেখ ঝিঙেফুল উড়ে যাচ্ছে ..আমায় ধরে দেনা …
— বাবা তুমি চুপ করো। কেউ উড়ে যায়নি, সব ফুল আছে ক্ষেত জুড়ে।
— ঐ দেখ সব উড়ছে …
বামির সান্তনা বাবাকে চুপ করাতে পারেনি। বাবার এমন অবস্থা দেখে বামি ডাক্তার বাবুকে ডেকে পাঠিয়েছিল । ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে বললে ..
— বামি — বুকটা শক্ত করো । তোমার বাবার আর….
বামি শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়ল ।
–না ডাক্তারবাবু এ কিছুতেই হতে পারেনা।
ডাক্তার বাবু সান্তনা দিয়ে বললে..
— শোন বামি , বাবার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করো। উনি ঝিঙে ফুল দেখতে চাইছেন , বাবাকে তুমি কিছু ঝিঙে ফুল এনে দাও ,অন্তত মরবার আগে প্রাণ ভরে দেখে নিক তার ক্ষেতের ঝিঙেফুল।
বামি তাই করে, সে ছুটতে ছুটতে চলে যায় মাঠে। ক্ষেতে তখন বাবুর লেঠেলরা পাহারা দিচ্ছিল। বামি তাদের বাবার শেষ ইচ্ছার কথা বলল কিন্তু বাবুর মর্জি ছাড়া তারা একটা পাতাও তুলতে দিতে চায় না । আমি তাদের হাতে পায়ে ধরল তবু তাদের মত পাল্টালো না। আমি তখন পাশের ক্ষেত থেকে কিছু ঝিঙেফুল তুলে যখন বাড়ি পৌঁছালে , দেখলো উঠোন জুড়ে লোক ভর্তি। আর ঘরের ভিতর থেকে কয়েকটি মেয়েলি কন্ঠের কান্না সবকিছু ছাপিয়ে ভেসে আসছিল । বামি ভিড় ঠেলে যখন ঘরে ঢুকলো তখন তাকে দেখে পাড়ার কয়েকজন ভীষণ জোরে কেঁদে ওঠে, ওই কান্নায় বলে দেয় তার বাবা আর নেই । বামি আস্তে আস্তে বাবার মৃতদেহের পাশে বসলো, ঝিঙেফুল গুলো বাবার বুকের উপরে চাপিয়ে দিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে বাবার মৃতদেহের দিকে। দুচোখে জলের ধারা নিঃশব্দে গাল বেয়ে ঝরে পড়ল বাবার নিথর দেহের ওপর ।
গোটা বাড়ি লোকারণ্য , তবু যেন কেউ কোথাও নেই , ফাঁকা গোটা বাড়ি, শূন্য গোটা গ্রাম, মরুভূমির নিস্তব্ধতা আর ধূসরতা সারা গ্রামজুড়ে। একটাও মানুষ নেই, একটাও প্রাণী নেই, সব যেন অন্তহীন অতল গভীরে তলিয়ে গেছে। গোটা গ্রাম গোটা শহর, গোটা দেশ আজ মৃত শ্মশানভূমি ,বেঁচে আছে শুধু তার বাবা আর তার ক্ষেতের ঝিঙেফুল ।

 

কীভাবে লেখা পাঠাবেন?
নীচে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার কিংবা ইমেল আইডিতে লেখা পাঠাতে পারবেন।
হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার~ 9636459953
ইমেল আইডি~ bengalliveportzine@gmail.com
লেখার সঙ্গে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং একটি ছবি পাঠানো আবশ্যক।
ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে নিজের তোলা দুটো ছবি পাঠাতে হবে।

Related News

Back to top button