পোর্টজিন

হসপিটালে শেষ খোলা চিঠি – বেদশ্রুতি মুখার্জী

Bengal Live পোর্টজিনঃ

হসপিটালে শেষ খোলা চিঠি – বেদশ্রুতি মুখার্জী

আজকের দিনটা ভয়ংকর গেল। আজ আমি জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পেলাম।

আসলে সেই মার্চ মাস থেকেই আমাদের জন্য সময়ের কাঁটাটা অতি দ্রুত ঘুরছে। বা বলতে পারেন দৌঁড়চ্ছে। এই দুমাস পৃথিবীর জন্য সময় যেমন থমকে গেছে, আমাদের জন্য ঠিক যেন তার উল্টোটা। বারো এমনকি চোদ্দ ঘন্টা পর্যন্ত ডিউটি আগেও করছি।কিই গত আটবছরের কেরিয়ারে এতটা স্ট্রেস আগে কখনো নিতে হয়নি। যদিও সেই ছোট্ট থেকেই আমি খুব খাটতে পারি, খুব খেটেও ছিলাম জানেন তো শুধুমাত্র এই একটা স্টেথোস্কোপ পাবার স্বপ্নটার জন্য।

আজো মনে আছে সতেরো বছর আগে মাত্র ষোলো বছরের আমি বাড়ি ছেড়েছিলাম কেবলমাত্র এই স্বপ্ন টা পূরণের খিদায়। CBSC 10th এ যখন টেন পয়েন্ট পেলাম তখন বুঝলাম আর এই উত্তর প্রদেশের ছোট গ্রামে থেকে খুব একটা আশা নেই, আব্বু বললেন, এলাহাবাদ বা লক্ষ্ণৌয় চাচার বাড়িতে থেকে ইলেভেন টুয়েলভ পড়তে, আমিই বলে ছিলাম, কোটায় পড়ব। খুব ভালো করে মনে আছে, এরকমই এক রমজান মাসের সন্ধ্যায় ইফতারে বসে কথাটা পেড়েছিলাম আমি, আর আব্বু ভয়ংকর বিষম খেয়েছিলেন। গলায় আটকে গেছিল চিকেন লেগপিসটার টুকরো, আসলে টুকরোটা বোধহয় আমার ই ফেলা বোমটার।

আর তখনই আম্মু বকাঝকা করা শুরু করে দিলেন, বলে কি, একটা মেয়ে অতদূর পড়তে যাবে। শুরু হলো চিৎকার, কনজারভেটিভ বাড়ির একটা মেয়ে এত কম বয়সে অতদূর একা কেন যাবে, “নিশ্চয়ই তোর কোন চক্কর আছে, এজন্যই আমি তোমাকে বলেছিলাম ইংরেজি স্কুলে পাঠিয়ো না”- কেঁদে বলেছিলেন আম্মু আব্বাকে। কিন্তু কিছু দিন ধরে টানা বোঝানোর পর দুজনেই এক সময় বুঝলেন যে আমার সত্যিই কোন চক্কর নেই, আসলে চক্করে পড়তে গেলেও যে সময় টা লাগে, আমার তো সেই সময়টাই কখনো ছিল না, আমার সারা দিন রাত কেটে যেত বইয়ের পৃষ্ঠায় সিঁদ কাটতে কাটতে। আমি যেন কলম্বাসের মতোই খুঁজে বেরাতাম সারাক্ষণই কিছু।

সেই কিছুটা আর কিছুই নয়, কেবল একটা স্টেথোস্কোপ। একটা রুটি ছাড়াও আমার দিন চলত, কিন্তু সারা দিন রাত না পড়ে আমি ভাবতেই পারতাম না জীবনটা, কোথা থেকে ঈদ আসত যেত টেরই পেতাম না। বাইরের জগৎ ছুঁতোনা আমায়। আমার কোন কিচ্ছু দরকার ছিল না এই পৃথিবীতে শুধু বই আর বই ছাড়া। পরীক্ষা দিয়েছিলাম সবার অলক্ষ্যে অনলাইনে, কোয়ালিফাইও করলাম, ফুল স্কলারশিপ পেলাম কোটার এক নামকরা স্কুলে, সারা দেশ থেকে মাত্র দশজন সিলেক্টেড, আমি তাদের মধ্যে একজন, এরপর আর আব্বু আম্মু কিছু বলতে পারেননি, পৌঁছে দিয়ে এলেন আমায়, রেখে এলেন হস্টেলে। আর ভর্তি হলাম এক প্রসিদ্ধ মেডিকেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এ। আজকালকার অ্যালেন এর চেয়েও অনেক বেশি নামকরা ছিল তখন এটা, দেশের অন্যতম প্রাচীন আর ততোধিক প্রসিদ্ধ মেডিকেল স্টুডেন্ট ট্রেনিং ইন্সস্টিটিউড।

তারপর আফটার 12th আমি চান্স পাই মতিলাল নেহেরু মেডিক্যাল কলেজ, এলাহাবাদ। আমাদের মহল্লায় প্রথম মেয়ে আমিই যে মেডিক্যালে চান্স পাই। উৎসব শুরু হয়ে গেছিল যেন, আজো মনে আছে মঞ্চ বেঁধে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, আব্বু ভাষণে বলেছিলেন-” ছেলে আর মেয়ে, সবাই সমান। সমান পরবরিশ এর হকদার, সবাইকেই যদি সমানভাবে আপনারা স্বপ্ন দেখতে ছেড়ে দেন, তো ঘরে ঘরে অনেক আয়েশা তৈরি হবে। আর আজ থেকে আমার আয়েশা ইয়াসমিন আপনাদের সবার।”

এরপর MBBS ও শেষ হয়ে গেল একসময়, আমি AIIMS এ মেডিসিন নিয়ে MD তে ভর্তি হই, এইপর্বে আমার জীবনে আসে সাইলুর। প্রথম আমার বইয়ের জগতে কালো অক্ষরগুলো রঙিন হয়। সাইলুর আলমগীর হাজারি, মুর্শিদাবাদ এর বেলডাঙার। আপনাদের পশ্চিমবঙ্গেরই। ক্যান্টিনে আলাপ হয়েছিল হঠাৎই আমার আর সাইলুর এর, এক সিনিয়র আপার থ্রুতে। সাইলুর পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি নিয়ে পড়ছিল, আমার একবছরের সিনিয়র। আমাদের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে অন্য মাত্রা পেল, ওর কাছেই আমার বাংলা শেখা।

পুরোপুরি MD কমপ্লিট হবার পরই বিয়ে হয় আমাদের। ততদিনে আমি বাংলা লিখতেও পারি। পড়ে ফেলেছি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল। কোরান শরিফের সঙ্গে ঠাঁই পায় নজরুল সমগ্র, সঞ্চয়িতা, গীতবিতান। নজরুল আমার প্রিয় কবি। কাণ্ডারী হুঁশিয়ার আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। যাইহোক তারপর জীবন কেটে যাচ্ছিল সুপার ফাস্ট ট্রেনের মতোই। আটমাস আগে মাও হয়েছি আমি, ফুটফুটে একটা মেয়ের জন্ম দিয়েছি, আয়েশা সাইলুর ইয়াসমিন এখন এক মা, কিন্তু ভীষণ অভাগা মা। এই গত দশদিন ধরে আমি বাড়ি যাবার সময় টুকুও পাচ্ছি না, এত ওয়ার্ক লোড। কিন্তু নেচার তো মানেনা, তাই কামিজ ভিজে যায় আমার সন্তানের খিদের ডিউটি দিতে দিতেই।

চোখ জ্বালা করে ওঠে, কল দিই আম্মুকে, আমার ছোট্ট শাকিনা খেল কিনা ল্যাকটোজেন জানতে। সাইলুরও খুব বিজি, ও এখন মুম্বাই এর টাটা মেমোরিয়ালে HOD. আর আমি ঔরঙ্গাবাদ হসপিটালে, দূরত্ব যতই হোক, মনের দূরত্ব বিন্দুমাত্র নেই। উইক এন্ডে ও এলে আমরা আবার আগের মতোই ভাসি, এমনকি মাঝরাতেও লং ড্রাইভে বের হই। ভীষণ ভালো ই ছিলাম আমরা।

তবে আজ সত্যিই মনটা ভেঙে গেল আমার। এবার আমি ছেড়ে দেব এই আমার এত সাধের আজন্ম স্বপ্নের স্টেথোস্কোপ টা। হ্যাঁ আমি আজ রেজিগনেশন লেটার লিখেছি, এই চিঠিটা টাইপ করেই সেটা ডিনকে সাবমিট করে আসব, মানলে ভালো, নইলেও থাকব না। আর ওয়েট না করে সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাব গাড়ি নিয়ে। তার আগে শেষবারের মত আবার একবার মর্গে যাব। ঠাণ্ডা ঘরে দেখব কিছু সদ্য পোস্টমর্টেম-সারা লাশের গায়ে লেগে আছে রাষ্ট্রের খিদে, যেমন নিউজ চ্যানেলে দেখলাম ছড়িয়ে আছে রেললাইনে রুটির টুকরো। আর চলন্ত মালগাড়িটা…

এটুকু আপনারা সবাই দেখেছেন, কিন্তু আমার মত অভাগা তো নন আপনারা, দেখেননি এই ঔরঙ্গাবাদ হসপিটালে নিয়ে আসা সেই অভুক্ত হতদরিদ্র ক্ষুধার্ত পরিযায়ী শ্রমিক ভাইদের লাশ। আমি দেখেছি, কেননা পোস্ট মর্টেম টা আমাকেই করতে হলো যে। আর ওদের রক্তে, ওদের পেটে একটা জিনিস কমন পেলাম তা হলো খিদে। আমার সন্তানের চেয়েও ওরা ভয়ংকর ক্ষুধার্ত। চারিদিকে এই ভয়াবহ সিচুয়েশনেও চলছে রাজনীতির তরজা, জাতের নামে বজ্জাতি। আর ওদের খিদের জ্বালার তীব্রতা দেখে আমার মর্গে মনে পড়ছিল আমরা এক ডুবন্ত নৌকার সওয়ারী। নজরুল কে আজ আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। আমার কান্নাভেজা গ্লাসে ঢাকা চোখ শুধু আওড়াতে চায়-
“বলো কাণ্ডারী ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার”…

ভালো থাকবেন সকলে, আর আপনাদের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হবেনা। কারণ ঔরঙ্গাবাদ হসপিটালের আপনাদের এই ডাক্তার আপারও আজ খিদের কাছে, যন্ত্রণার কাছে মৃত্যু হয়ে গেল, এবার শুধু শাকিনার সাধারণ একটা হাউজওয়াইফ মা বেঁচে থাকবে। এটা আমার এক নতুন শুরুয়াত।
“আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ…”
হ্যাঁ চলুক আরো মিডিয়ার প্রচার, হোক আরো রাজনৈতিক দরাদরি, দোষারোপের পাহাড়, পরিযায়ী দের খিদে আরো বাড়ুক, গিলে খাক অজগরের মতোই এই আমাদের, এমনকি রাষ্ট্রের ভিতটাকেও। আরো ভাইরাস শেষ করে দিক আমাদের, খুবলে নিক আমাদের জীবন টা। সত্যি বলতে কী, আসলে আমরা সকলেই তো এক একটা জীবন্ত লাশমাত্র। আজ যেমন আমি শুধু এতগুলো খিদেয় অভুক্ত মানুষের পোস্ট মর্টেম করলাম না, পোস্ট মর্টেম করলাম আমার জীবনটারও। সত্যিই তো এত পরিশ্রমে পাওয়া এই স্টেথোস্কোপ আর ডাক্তার আপা নামটা আমার সব সময়, সব সুখ, সব বেঁচে থাকার রসদ কেড়ে নিচ্ছে তিলে তিলে, শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু মিছিল যন্ত্রণা আর আতঙ্ক এর পসরা ছড়াচ্ছে।এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়, হতে পারে না।

অথচ একটা শান্তির রুটিই তো যথেষ্ট, সেটাই তো আমি চেয়েছিলাম, শান্তিতে সেবা করব সবার, প্রাণ ফেরাব সকলের, তবে কেন আজ হেরে গেলাম অভুক্ত মানুষের এই সর্বগ্রাসী খিদের কাছে, ওদের রুটিটা আমার গলার রুটির টুকরোটাকে আটকে রাখছে যেন। তাই একমুহূর্তও আর নয়, এনাফ হলো আজ, এনাফ হলো, আগেও দাঙ্গায় দেখেছি এভাবেই লাশের পর লাশের মিছিল আসে, ঘেন্নায় বলি যারা, নিজেদের নয়, শাসকের। আজ খিদেয় মৃত্যু দেখলাম মৃত্যুঞ্জয় এর মতোই।
তাই আর পারব না হয়তোবা, হয়তোবা সব কিছু ঠিক হবে একদিন, পৃথিবী আবার শান্ত হবে, গান গাইবে আকাশ বাতাস, কিন্তু জিতে যাওয়া বলে কী একে? এত অভুক্ত মানুষের মৃতদেহের ওপর দিয়ে জেতা যায় কী??? জানিনা, এরকম জীবন আমি চাইনি কখনো, তাই চলি, সকলে ভালো থাকবেন, আল্লাহাফেজ।
– আপনাদের ডাক্তার আপা, আয়েশা সাইলুর ইয়াসমিন।
08/05/2020

Related News

Back to top button