“প্রেমের ছবিগুলো” লিখেছেন কৌশিক পাল

মাঝখানে প্রেমটা এত উৎপাত শুরু করল, যে রোজ রাতে একবার ওর বুকের গন্ধটা সারা মুখে না মাখলে ঘুম হত না। মাঝে মাঝে তো আমার সর্বাঙ্গ নিশপিশ করে উঠত ওর দেহের ঝলকানিতে। গিলে ফেললে তো সব শেষই হয়ে যেত,নাহলে গিলেই ফেলতাম এতদিনে! কতটা সুন্দর ও, তা জানি না। কার কাছে কেমন, তা’ও জানি না। কে কোন চোখে দেখে ওকে , তা জানা তো একেবারেই অসম্ভব! যদিও খুব একটা বাড়ি থেকে বের হয় না ও। যতটুকু সময় শপিং-এ বা দোকানে যেত,ততটুকুই যা বাইরে।আর আমার সঙ্গে ক-দিন যা ঘোরাফেরা– ততটুকুই বিয়ের পর।
প্রথমে একটু নতুন নতুন ভাব, দুজনকেই একটু লজ্জা আর চরিত্রকে সঙ্গে নিয়ে সমঝে চলতে হত। তারপর, দুজনেরই একদিন প্রায় একসাথেই একরাতের মধ্যে সব লজ্জা উধাও! তারপর কতকগুলো রাত যে এমনি ভাবে কাটতে লাগলো, যেন সেগুলোকে রসলীলা ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। খুব বেশিদিন হয়নি তখন। ষাট-সত্তর দিনের দাম্পত্য জীবন–আর তাতেই এত………
আজ দাম্পত্য জীবনের পুরো দুশো একদিন।আমার লেখালেখির ঘরটা এলোমেলো হয়ে পরে আছে। ঘরের একদিকে আমার লেখালেখির কাগজপত্র ও খাতার আলমারি। দু’দিন হল, সেটাকে ফাঁকা করে দামী বিদেশি মদ এনে সাজিয়েছি। ও জানে না খবরটা। শুধু আমায় একব্যাগ ভর্তি ফল আর ড্রাই ফ্রুটস আমার ঘরে নিয়ে যেতে দেখেছে। কিছুই বলেনি তেমন। মনে অবশ্যই খটকা লেগেছে ওর, কারণ ফ্রিজ ভর্তি এত ফল সবকিছু থাকতে আবার আমি এত কিনে এনেছি! তাই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
গতকাল থেকে বন্যার স্রোতের মতো মদ আর ফল খেয়েছি।এ ঘরে ওর আনাগোনা নেই বললেই চলে। আর এঘরে কারও ঢোকাটাও আমি পছন্দ করি না। আমার স্মার্ট ফোনটা সারাক্ষণই প্রায় আমাদের শোবার ঘরে থাকে।খুব দরকার হলেই আমাকে ও ফোনটা এনে দেয় এ ঘরে।তাতে আমি খুব একটা আপত্তি করি না। আমার বিশাল টেবিলটার, মাঝখানে রাখা টেলিফোন। সারাদিন ওখানেই বেশি ফোন আসে। আর ও এঘরে আমাকে খাবার দিতে বা অন্য কোনো কাজ থাকলে টেলিফোনে ফোন করে অনুমতি নিয়েই আসে। আমি ওকে অবশ্য অনুমতি নিতে বলিনি কোনোদিন, তবুও ও অনুমতি নিয়েই আসে।
গত চারদিন ধরে একটা অচেনা গলা আমাকে বারে বারে ফোন করে, আমার গলাকে তার গলার বন্ধু বানাতে চাইছে।আমার যে ঘরে স্ত্রী রয়েছে, সে হয়তো জানে অথবা জানে না! নিজের পরিচয় তো দূরের কথা, নামটা পর্যন্ত বলেনি! তবুও একটা অদ্ভুদ জাদু আছে ওর গলায়! আমার অনুরাধার দেহের টানের থেকেও যেন হাজার শক্তিশালী এই মেয়েটার গলা! শুধু বলে ওর নাকী আমার লেখা খুব ভালো লাগে, একটা বইমেলায় আমাকে দেখেছে,আমার সাথে নাকি একটা সেলফিও নিয়েছে! আমার সবকটা বই ওর কেনা।ঘরে নাকি প্রতিদিন ওই বইগুলোর গন্ধ শুকে আমাকে অনুভব করে! আর এখন নাকি আমাকে বিয়ে করতে চায়!সবচেয়ে বিস্ময়কর এই শেষের বাক্যটা!
সে তো কত মেয়ে-গুরুজন-বন্ধু-মহিলা — হাজারটা লোকের সাথে কথা হয় রোজ।কত লোক আমার সাথে সেলফি তুলেছে,কত বইমেলা করেছি-গিয়েছি,তাকে কি মনে রাখা সম্ভব?কিন্তু ও যখনই ফোন করে কথা বলে, আমাকে যেন হিপ্নোটাইস করে দেয়!আমার যে স্ত্রী রয়েছে সেটা বলতে গিয়েও, যেন কথা পালটে যায়! কী আশ্চর্যের ব্যাপার!
দু’দিন ধরে অজস্র ফোন এসেছে,একটাও ধরিনি। অনুরাধা অনেকবার ফোন করেছে এমনকি দরজাও চাপড়েছে এই বলে যে,”কি গো কী হল?খাবার খাবে না? ঘরেই থেকে যাবে নাকি?”
আমি শুধু একটামাত্র হ্যাঁ, না সাড়া দিয়ে চুপ করে যেতাম। অনুরাধাও খায়নি বোধ হয় দু’দিন।কারণ আমি তো জানি যে ও আমাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে;আর আমিও কম নয়।
আবার আজ রাত আটটায়, ওই একই অচেনা গলাটা ফোনটা তুলতেই কানে এল।যেন আমায় ওর গলায় গ্রাস করতে চায়! এত মদ খেয়েছি যে গলা বসে গেছে।কিন্তু ওই মেয়েটার অভাবনীয় মধু মাখা মিষ্টি গলাটা কানে পড়তেই, যেন একনিমেষে সব নেশা কেটে গেল!শুধু ওর কথা শুনে যাচ্ছিলাম নির্বিবাক হয়ে। তারপর ফোনটা ও কাটলো নাকি এমনিই কেটে গেল, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না।তাই ইতিমধ্যে দুটো ন্যাশপাতি,তিনটে আপেল,একবাটি কাজু আর দুবোতল মদ খেয়ে এই এতটুকু লিখতে বসেছি।রাতে অনুরাধা শুধু দুবার দরজা ধাক্কা দিয়ে খাবার কথা বলে গেল।আমি রীতিমতো সাড়া দিয়ে উঠতে পারিনি, তাই হয়তো ঘুমিয়েছি ভেবে রাগে ফোনও করেনি।
আজ তিনদিন।টেবিলের তলায় মদের প্যাকেট ও বোতলে ভরে গেছে।টেবিলের উপর একটা বোতল ছিল, কিছুটা মদ ছিল তখনও।ঘুম থেকে উঠেই গেলাসে অর্ধেকটা রেখে, ওটা শেষ করলাম আগে। কী যেন একটা পাখির ডাক শুনতে পেলাম।আর তাতেই হয়তো ঘর থেকে বেরিয়ে দরজায় খিল দিয়ে দৌড়ে ছাদে গেলাম।বেশ একটা ফ্রেশ সকাল মনে হল।অনেকক্ষণ ছাদে কাটানোর পর নীচে নেমে সোজা গেলাম শোবার ঘরে।দেখি বিছানা গোছানো।ফোনটা আমার বালিশের পাশে।বাথরুমে গিয়ে বুঝলাম,অনুরাধা একটু আগেই বোধ হয় স্নান সেরে বের হল।তারপর হালকা হয়ে সকাল সকাল স্নান সেরে রান্নাঘরে যেতেই দেখি ও চা বানাচ্ছে।প্রথমে একটাই কাপ ছিল,তারপর আমার জুতোর আওয়াজ ও শ্যাম্পুর গন্ধ পেয়ে আরেকটা কাপ বের করতে করতে বলল-“চা-টা কি দরজা বন্ধ করেই খাবে? নাকি বারান্দায় দেব?”
আমি বললাম-“বারান্দাতেই দাও, আর ঠাট্টা কোরো না।” পাছে হয়তো কথা বাড়ে, তাই ও আর কিছু বললো না।আমি সোজা গিয়ে বারান্দায় বসলাম।ট্রেতে দুটো এলাইচি দুধ চা ও সাথে আমার প্রিয় বিদেশি বিস্কুট।ও আর কিছু বলল না তখন।চা-টা শিগগির শেষ করে ও সামনের বিরাট ফুল বাগানে চলে গেল,গাছে জল দিতে।আমি বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ ধরে অনুরাধাকে পর্যবেক্ষণ করলাম।ভারী মিষ্টি লাগছিল সালোয়ার কামিজে। বিয়ের পর একদিন আমায় বলেছিল,যে বিয়ের আগে ও জিন্স পড়ত।বাবা সেসব পছন্দ করেন না জন্য আর পড়েনি।আমার ওসবে আবার কোনোরকম আপত্তি নেই।কারণ নারীকে তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। আর তারপরই তো সমাজকে চেনা যাবে।
সিগারেট বা তামাকের নেশা আমার নেই।এমনকি মদেরও না।তারপর হঠাৎ দু’দিনের কথা সব মনে পড়ে গেল। ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে টেবিলে বসতেই একটা খুব পরিচিত গন্ধ পেলাম।গেলাসের চারপাশে মদের ফোঁটা পরে আছে।গেলাসটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে নিতেই পুরোনো টাটকা গন্ধটা পেলাম।যে গন্ধের সাথে আমার কদিন আগে পর্যন্ত পরিচয় হত রোজ রাতে, ঘনিষ্টভাবে,সেই গন্ধ–অনুরাধার বুকের গন্ধ।ওর গলার হিরেটা গ্লাসে পড়েছিল,নয়তো ও এই দু’দিনের লেখাটা পড়েই হিরেটা গ্লাসে ডুবিয়েছিল। আমি একথা জোর দিয়ে বলতে পারি।আর তাই টেবিলে মদের ফোঁটা পড়ে রয়েছে।
ওকে আমি হিরেটা ফুলশয্যার রাতে দিয়েছিলাম। সেকথা ভাবতে ভাবতেই অনুরাধার বুকের গন্ধমিশ্রিত মদ খেয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।গা-টা মোচড় দিতেই যেন একটু ঘুম ঘুম পেল।সেসময় শুধু অনুরাধার মুখটা আর রাতগুলো মনে পড়ছিল।
তারপর দেখি হঠাৎ অনুরাধা ঘরে খাবার ও ফোনটা একসাথে এনে টেবিলে রেখে আমাকে ডাক দিচ্ছে,আর বলছে-“কী গো অনিরুদ্ধ ওঠো,দু’টো বাজে যে!খাবার এনেছি আমাদের।আমি আর তুমি একসাথে খাব আজ এঘরে।ফোনটাও এনেছি। অ্যানা নামের ওই মেয়েটি টেলিফোনে না পেয়ে এন্ড্রয়েডে ফোন করেছিল অনেকবার। মনে হয় তোমার ‘প্রেমের ছবিগুলো’ বইটি আরও দুকপি নেবে।
“কী গো ওঠো;সেই যে রাতে বিনা গন্ধে ঘুমিয়েছো!”