বেঙ্গল লাইভ Special

করোনা – বায়োলজি, বিশ্বপুঁজির খেলা এবং আমাদের অস্তিত্ব

Bengal Live বিশেষ প্রতিবেদন, ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্যঃ

গোড়ার কথা – করোনার মৃত্যুমিছিল

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর (২৭ মার্চ, ২০২০) খবর ছিল – “Coronavirus in the U.S.: Latest Map and Case Count” অনুযায়ী অন্তত ৮৫,৩৮১ জন মানুষ আক্রান্ত এবং অন্তত ১,২৭১ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আর CDC (Centers for Disease Control and Prevention)-র মতো আন্তর্জাতিকভাবে মান্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ৩০ মার্চ, ২০২০-তে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪০,৯০৪ এবং মৃত ২,৪০৫ জন। ৩১.০৩.২০২০-তে এসে সিএনএন সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী – The United States has the most confirmed cases globally at over 160,700. More than 3,000 people have died in the US — over 1,200 in New York State.

আর জুন মাসের ৩ তারিখে (৩.০৬.২০২০)-তে আমেরিকাতে মোট কনফার্মড করোনা পজিটিভ কেসের সংখ্যা ১,৮৭,০০০০ (প্রায় ২ কোটি), মৃত্যু ১ লক্ষ ৮০০০-এর বেশি। করোনা আক্রান্ত ১৪% মানুষের মৃত্যু ঘটেছে আমেরিকায়। যদিও ক্ষীণ আশার কথা বিবিসি সংবাদ সংস্থার (২.০৬.২০২০) মার্চ মাস পরবর্তী সময়ে এই প্রথম ইংল্যান্ডে প্রতিদিন যে হারে মানুষের মৃত্যু ঘটছিল তার থেকে মৃত্যুহার কমেছে। একই সাথে ইংল্যান্ডের পাব্লিক হেলথ বিভাগ জানিয়েছে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর হার ৮০ বছর পেরিয়ে গেলে ৭০ গুণ বৃদ্ধি পায়।

উল্লেখ্য, একই সাথে সিএনএন সংবাদ সংস্থার পূর্বোক্ত রিপোর্ট আরেকটি সতর্কবাণী করেছিল বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার ব্যাপারে – A new World Bank report warns the spread of Covid-19 could bring recession to countries in East Asia and the Pacific and push 11 million people into poverty. এর মানে হল, পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মন্দার ফলে ১ কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়বে। ওয়াশিংটন পোস্টের মতো সংবাদপত্রের ৩১.০৩.২০২০-র শিরোনাম – “Americans told to brace for 200,000 coronavirus deaths as world leaders push crisis response further”। এই মুহূর্তে (৩.০৬.২০২০) পৃথিবীতে করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬২,০০,০০০। মৃত্যু হয়েছে ৩,৭৬,০০০ জনের। প্রথম স্থানে আমেরিকা, দ্বিতী্‌য়, ইংল্যান্ড – আক্রান্ত ২,৭৮,‌০০০ এবং মৃত্যু ৩৯, ৩৬৯ জনের। তৃতীয়, ব্রাজিল – আক্রান্ত ৫৫,৮০০ এবং মৃত্যু ৩১,৩০৯।

সিঙ্গাপুর, জাপান, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম সফলভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণের মোকাবিলা করেছে। এখানে জোর দিয়ে উল্লেখ করার মতো খবর হল – ভিয়েতনামে, যার সাথে ১১০০ মাইল ল্যান্ড বর্ডার আছে, মৃত্যুর সংখ্যা শূণ্য। একইরকম হল কম্বোডিয়া এবং মঙোলিয়াতে – কোন মৃত্যুর খবর নেই। উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া।

এর মধ্যে সিঙ্গাপুরের মডেল নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে গভীর আলোচনা হচ্ছে। ল্যান্সেট-এর মতো জার্নালে (২৩.০৩.২০২০) সুদীর্ঘ গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে “Interventions to mitigate early spread of SARS-CoV-2 in Singapore: a modelling study”। এই স্টাডিতে দেখার বিষয় ছিল স্থানীয়ভাবে রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে অবরুদ্ধ করে রাখা বা containment কতটা সফল হয়। এদের সিদ্ধান্ত – Implementing the combined intervention of quarantining infected individuals and their family members, workplace distancing, and school closure once community transmission has been detected could substantially reduce the number of SARS-CoV-2 infections. এ পেপারে আরও বলা হয়েছে একটি অঞ্চলের জনসংখ্যার মাঝে কতজন উপসর্গহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে নিরপেক্ষভাবে “all the proposed interventions should be used in addition to other measures, such as rapid diagnosis and appropriate case management, if local containment fails.”

ল্যান্সেটে (২৬ মার্চ, ২০২০) প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম – “COVID-19 gives the lie to global health expertise”। সে রিপোর্টে খুব তীক্ষ্ণ ভাষায় বলা হয়েছে – The US and UK Governments have provided among the world’s worst responses to the pandemic, with sheer lies and incompetence from the former, and near-criminal delays and obfuscation from the latter. শুধু এটুকু নয়, বলা হয়েছে – Neither country has widespread testing available, as strongly recommended by WHO, alongside treatment and robust contact tracing. দুটি দেশের কোনটিতেই স্বাস্থ্যকর্মী এবং ডাক্তারদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক পিপিই (personal protective equipment) নেই। পৃথিবীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং ডাক্তারির ধরন হয়তো কোভিড-১৯ পরবর্তী পৃথিবীতে হয়তো চিরকালের জন্য বদলে গেলো – Global health will never be the same after COVID-19—it cannot be.

করোণা ভাইরাসের বায়োলজি

এতদিনে আমরা সবাই জেনে গেছি চারপাশে সূর্যের ছটার মতো প্রোটিনের গঠন থাকার জন্য এর নাম করোনাভাইরাস।

(করোনাভাইরাস – চারপাশে সূর্যের ছটার মতো – এজন্য এই নাম)

এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ভাইরাসের শরীরের ওপরে এক বিশেষ ধরনের “স্পাইক প্রোটিন” থাকে। এই প্রোটিনের সাহায্যে মানুষের কোষের রিসেপ্টরের ওপরে ভালোভাবে গেঁথে গুছিয়ে বসতে পারে। এবং ভাইরাসটি এর নিজের ইচ্ছেমতো কোষের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে যার ফলে বিভিন্ন উপসর্গ মানুষের শরীরে দেখা যায়। অদ্ভুত অদ্ভুত সব উপসর্গ তৈরি হয়, যেমন জ্বর, শুকনো কাশি, গলা এবং শরীরে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রক্তনালীর হিমোগ্লোবিন ভেঙ্গে যাওয়া। আবার একইসাথে রক্ত জমাট বেঁধেও যায় এবং সেরকম জমাট বাঁধা রক্তনালী দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে গিয়ে ব্রেন স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি হয়। এমন বহু রোগী দেখা গেছে যাদের হিমোগ্লোবিন ভেঙ্গে পরফাইরিন বলে একটি রাসায়নিক যৌগ তৈরি হয়েছে। ফলে রক্ত দিয়ে কোন অক্সিজেনের আদান-প্রদান ফুসফুসে হচ্ছেনা, অথচ সেরকমভাবে শ্বাসকষ্টের কথা বলছেনা।

একেবারে সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র – “An outbreak of severe Kawasaki-like disease at the Italian epicentre of the SARS-CoV-2 epidemic: an observational staudy” (Lancet – ১৩.০৫.২০২০) দেখাচ্ছে যে মারাত্মক “কাওয়াসাকি ডিজিজ” ভারতে শিশুদের ক্ষেত্রে ১,০০,০০০ শিশুর মধ্যে ১টি ঘটে থাকে সে অসুখের প্রায় “30-fold increased incidence of Kawaski-like disease” ঘটেছে ইতালিতে, অর্থাৎ ১ লক্ষ শিশুতে ১ জনের হয় এরকম এক দুর্লভ রোগ কাওয়াসাকি ডিজিজ করোনা আক্রান্তদের মাঝে ৩০ গুণ বেড়ে গেছে।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে-এ (১৫.০৫.২০২০) প্রকাশিত একটি বৃহৎ গবেষণাপত্রে “Severe Covid-19”-এ বলা হয়েছে – “A hallmark of the Covid-19 pandemic is the sudden appearance of an unprecedented number of critically ill patients in a small geographic area.” উপসর্গের বিস্তার একটি গ্রাফের সাহায্যে বোঝানো হয়েছে। এ লেখাতেই মন্তব্য করা হয়েছে – Little is known about the pathogenesis and treatment of the new disease.

এছাড়া রয়েছে দুটি মারাত্মক পরিণতি – (১) cytokine storm – যখন শরীরে সমগ্র ইমিউন সিস্টেম ঝড়ের মতো আচরণ করে এবং শরীর একে সামলাতে পারেনা, এবং (২) fulminant myocarditis – আমাদের হার্ট আর স্বাভাবিক আচরণ করতে পারেনা এবং ফেইল করে, যাকে চিকিৎসায় সামলানো প্রায় দুঃসাধ্য। মোট কথা হল মাত্র ৫ মাসের মধ্যে একের পরে এক নিত্যনতুন উপসর্গ এবং প্যাথোফিজিওলজির পরিবর্তন আমাদের হদিশে আসছে। আমরা আরেকবার বুঝতে পারছি যে ভাইরাসটি সম্বন্ধে আমরা এখনো খুব সামান্য জানি – আমাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের ধারণা সত্ত্বেও।

নেচার মেডিসিনের মতো গ্রাহ্য পত্রিকায় (১৭.০৩.২০২০) একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপ্রসূত চিঠি প্রকাশিত হয় “The proximal origin of SARS-CoV-2” শিরোনামে। সে চিঠিতে স্পষ্ট করে জানানো হয় – Our analyses clearly show that SARS-CoV-2 is not a laboratory construct or a purposefully manipulated virus. মূল কথা, এ ভাইরাসটি কোন ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়নি। তার কারণও নিহিত আছে স্পাইক প্রোটিনের বৈশিষ্ট্যের মাঝে। গবেষকদের বক্তব্য – the high-affinity binding of the SARS-CoV-2 spike protein to human ACE2 is most likely the result of natural selection on a human or human-like ACE2 that permits another optimal binding solution to arise. This is strong evidence that SARS-CoV-2 is not the product of purposeful manipulation. এর বাংলা করা প্রায় দুঃসাধ্য। সংক্ষেপে সহজভাবে বললে এটুকু বলা যায় স্পাইক প্রোটিন যে পদ্ধতিতে প্রবল আসক্তি নিয়ে কোষের রিসেপ্টরের সাথে লেগে যায় (ACE2 রিসেপ্টর যা আমাদের কিডনি, ফুসুফুস ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে থাকে, সেসব অঙ্গের কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কিছু উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ এই রিসেপ্টরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি করা হয়) তাতে দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয় এটা ভাইরাসের বিবর্তনের ফলে তৈরি হয়েছে। কোন জিন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নয়। ফলে মহাশক্তিধর ট্রাম্পের বলা “Chinese virus”-কে কেন্দ্র করে যেসব কন্সপিরেসি থিওরি বাজারে গুজব হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে এ ভাইরাস সেরকম কল্পবিজ্ঞানের মতো ল্যাবরেটরিতে তৈরি একেবারেই নয়। প্রাকৃতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া একটি অসীম শক্তিশালী, ক্ষতিকর ভাইরাস যে এখন প্রাণীদের শরীরের বদলে মানুষের শরীর পেয়ে গেছে নিজের অসম্ভব সব কাণ্ড ঘটানোর জন্য।

প্রশ্ন হচ্ছে এতদিন বাদুড়ের দেহে বাস করা ভাইরাস (সম্ভবত মধ্যবর্তী আরেকটি প্রাণী প্যাঙ্গোলিনকে পেয়েছিল নিজের জিনের চরিত্র বদলের জন্য) মানুষের শরীরে এলো কি করে? এর কোন সরল, একরৈখিক, একমাত্রিক উত্তর নেই। এখানেই আমাদের ভাবতে হবে নিওলিবারাল অর্থনীতি, পুঁজির সর্বময় অস্তিত্ব এবং কর্পোরেট পুঁজির প্রয়োজনে কিভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক অঞ্চলগুলো মুনাফার লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এবং তার ফলে বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক ভারসাম্য ভেঙ্গেচুড়ে গেছে, প্রকৃতির নিজস্ব বাসিন্দারা মানুষের দেহে এদের নতুন বাসস্থান খুঁজে নিয়েছে। আমরা নিত্যনতুন মারণ রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। এ বিষয়ে পরে আরেকটু বিস্তৃত আলোচনা করবো।

বিজ্ঞানী যখন ডিটেক্টিভ

নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় (২৭.০৩.২০২০) ক্যারোলিন করম্যান একটি সুদীর্ঘ, তথ্যবহুল প্রবন্ধ লিখলেন “From Bats to Human Lungs, the Evolution of a Coronavirus”। লেখাটি শুরু হচ্ছে এভাবে – For thousands of years, a parasite with no name lived happily among horseshoe bats in southern China. The bats had evolved to the point that they did not notice; they went about their nightly flights unbothered. One day, the parasite—an ancestor of the coronavirus, SARS-CoV-2—had an opportunity to expand its realm. Perhaps it was a pangolin, the scaly anteater, an endangered species that is a victim of incessant wildlife trafficking and sold, often secretly, in live-animal markets throughout Southeast Asia and China. হাজার হাজার বছরে ধরে দক্ষিণ চিনের ঘোড়ার খুড়ের মতো দেখতে বাদুড়ের মধ্যে এই ভাইরাসেরা সুখে বাস করছিল। বাদুড়েরা রাতে মহানন্দে উড়ে বেড়াতো। (এখানে উল্লেখযোগ্য, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন স্তন্যপায়ীদের মধ্যে একমাত্র বাদুড় জোরে উড়তে পারে বলে সম্ভবত বিভিন্ন ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ইমিউনিটি গড়ে তুলতে পারে, যেটা আমাদের নেই।) তারপরে বাজারের নিয়ম মেনে এরা অ্যানিম্যাল মার্কেটে চলে এলো মানুষের সর্বগ্রাসী খিধে মেটানোর জন্য। এবং ভাইরাস বাসা বাঁধলো আমাদের শরীরে – তার এক নতুন আশ্রয় মিললো।

২০০৩-এ যে সার্স-কোভ-১ আবিষ্কার হয়েছিল। অন্যতম আবিষ্কারক ছিলেন জোনাথান এপস্টাইন। সে এক রূদ্ধশ্বাস কাহিনী। চিনের গুয়াঙ্গডনের বাজারে যে বাদুড় খাদ্য হিসেবে বিক্রি হত তাতে এপস্টাইনের সন্দেহ হয় বাদুড় থেকে সার্স-কোভ-১ উৎস। এপস্টাইন ঐ অঞ্চলের চুনাপাথরের গুহায় ক্যাম্প করে থেকেছিলেন। আর রাত্রিবেলা ডজন ডজন বাদুড়ের লালারস সংগ্রহ করতেন। এভাবে বাদুড়ের চারটি প্রজাতিকে খুঁজে পান যাদের জিনের সাথে সার্স-কোভ-১-এর জিনের ৯০%-এরও বেশি মিল আছে। ২০১৩ সালে এপস্টাইন এবং সহ-গবেষিকা শি ঝেং-লি বাদুড় থেকে পাওয়া জিনের সিকোয়েন্সিং করে সার্স-কোভ-২-র জিনের সাথে ৯৬% জিনগত সাদৃশ্য পান। কিন্তু যেহেতু দুটির মধ্যে ১০০% সাদৃশ্য পাননি সেজন্য তাঁদের ধারণা মাঝে এই ভাইরাসের আরেকটি মিউটেশন হয়েছে অন্য কোন প্রাণীর মাঝে (সম্ভবত প্যাঙ্গোলিন)।

ভাইরাসের বায়োলোজি নিয়ে আরও দুকথা

একেবারে অজানা এই মারণান্তক ভাইরাসকে বোঝার জন্য শ্রেষ্ঠ মেধার বিজ্ঞানী, চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মী, এপিডেমিওলজিস্ট সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জানুয়ারি (২০২০) থেকে প্রায় হাজারখানেক প্রকাশিত, প্রাক-প্রকাশিত, অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে এবং BIOxiv-তে (একটি প্রাক-প্রকাশনা গবেষণাপত্রের পোর্টাল) পোস্টেড হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে ১০০০-এর বেশি করোনাভাইরাস জিনোম সিকোয়েন্স public darabase-এ পারস্পরিক লেনদেন করার জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীদের কথায় – SARS-CoV-2 behaves like a monstrous mutant hybrid of all the human coronaviruses that came before it. It can infect and replicate throughout our airways. এর আগে যে ACE-2 receptor-এর কথা বলেছিলাম বর্তমানের করোনাভাইরাস ২০০২-০৩-এর সার্স ভাইরাসের ১০ গুণ বেশি কার্যকরীভাবে এই রিসেপ্টরগুলোর সাথে বেঁধে যেতে পারে। এজন্য শ্বাসকষ্টের প্রাবল্য এত বেশি হয়। আরও কথা হল যে এদের অতি দ্রুত এবং ঘন ঘন মিউটেশন হতে থাকে। শ্বাসনালীতে পৌঁছনোর পরে আরও বেশি ঘটে এটা।

বর্তমানে Real-time quantitative fluorescence polymerase chain reaction (RT-qPCR) testing of respiratory specimens for SARS–CoV-2 RNA ব্যবহার করা হয় সংক্রমিত কে তাকে চিহ্নিত করা এবং কতদিন হাসপাতালে থাকা প্রয়োজন সেটা নির্ধারণ করার জন্য। অ্যানালস অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন-এ প্রকাশিত একেবারে সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র (৩০.০৩.২০২০) “ARS-CoV-2–Positive Sputum and Feces After Conversion of Pharyngeal Samples in Patients With COVID-19”-এ ১৩৩ জন রোগীর ওপরে পরীক্ষা করে বলা হয়েছে যে ২২ জন রোগীর ক্ষেত্রে “who had positive RT-qPCR results for SARS–CoV-2 in the sputum or feces after pharyngeal swabs became negative.” ভাইরাস বায়োলজির এ হল আরেক গভীরতর সমস্যার কথা। থুতু কিংবা মলে কোন ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছেনা, অথচ যে এনজাইমের সাহায্যে পরীক্ষা করা হচ্ছে তার খোঁজ মিলছে ভাইরাস মুক্ত রোগীর রক্তে। এবার একে কি সংক্রমণ মুক্ত বলা যাবে? এরকম নিত্যনতুন গবেষণালব্ধ তথ্য উঠে আসছে। ফলে ভাইরাস বায়োলজি আমাদের কাছে এখনো অধরা।

জার্মান গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে সংক্রমিত রোগীরা উপসর্গ পরিস্ফুট হবার আগে প্রচুর পরিমাণে ভাইরাস চারপাশে ছড়ায়। এমনকি ৩৭ দিন পর্যন্ত এরকম ভাইরাস ছড়ানো চলতে পারে। এবার ভাইরাস যে ছড়িয়ে পড়বে তার দুটো মাধ্যম – (১) এরোসল বা কফ, থুতু, কাশি, হাঁচি ইত্যাদি এবং (২) fomite বা কোন শক্ত বস্তু যেমন পিচবোর্ড, ধাতব বস্তু, কাঁচ, প্লাস্টিক ইত্যাদি। প্রথম ক্ষেত্রে ৩ ঘন্টা মতো সংক্রমক অবস্থায় থাকতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তামার ওপরে ৪ ঘণ্টা, পিচবোর্ডে ২৪ ঘন্টা, প্লাস্টিকে ৩ দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। যদিও প্রথম ১০ মিনিটে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়। তারপরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

সমাজের যে অংশের মানুষেরা বেশি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে তারা হল – (১) ৬০ বা এর চেয়ে বেশি বয়সী, (২) ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা নিউমোনিয়ার মতো অন্য কোন রোগে আক্রান্ত, (৩) যারা ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ খাচ্ছে ইত্যাদি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা দেখাচ্ছে ৩০ দিনের শিশু এবং মা থেকে শিশুতে সংক্রমপণের ঘটনাও ঘটছে। কম্বয়সীরা তুলনায় নিরাপদ। তবে বিপন্মুক্ত নয়। করোনাভাইরাসে যাদের মৃত্যু ঘটে তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ দুটি – (১) ডাক্তারি পরিভাষায় বললে “cytokine storm syndrome” যখন অত্যন্ত মাত্রাছাড়াভাবে শরীরের আভ্যন্তরীন ইমিউন রেস্পন্স তৈরি হয় যার ফলে আক্রান্তের ফুসফুস চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক গবেষকের কথায় – “It is almost like an autoimmune disease; the immune system is attacking parts of the body that it should not.” এবং (২) “fulminant myocarditis” যার ফলে অতি দ্রুত এবং মারাত্মক হার্ট ফেইলিউর হয় যাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসাধ্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ACE2 inhibitor নিয়ে বিতর্ক। কিন্তু ১৭ মার্চ, ২০২০-তে প্রকাশিত জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর একটি গবেষণাপত্রের শিরোনাম “Patients taking ACE-i and ARBs who contract COVID-19 should continue treatment, unless otherwise advised by their physician”। ব্যথা কমানোর ওষুধ ইবিউপ্রোফেন নিয়েও একই কথা। একমাত্র তাড়াহুড়ো করে লেখা ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি চিঠি ছাড়া আর কোথাও একে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এ নিয়ে ১৭ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এতদিন বাদুড়ের দেহে বাস করা ভাইরাস (সম্ভবত মধ্যবর্তী আরেকটি প্রাণী প্যাঙ্গোলিনকে পেয়েছিল নিজের জিনের চরিত্র বদলের জন্য) মানুষের শরীরে এলো কি করে? এর কোন সরল, একরৈখিক, একমাত্রিক উত্তর নেই। এখানেই আমাদের ভাবতে হবে নিওলিবারাল অর্থনীতি, পুঁজির সর্বময় অস্তিত্ব এবং কর্পোরেট পুঁজির প্রয়োজনে কিভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক অঞ্চলগুলো মুনাফার লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এবং তার ফলে বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক ভারসাম্য ভেঙ্গেচুড়ে গেছে, প্রকৃতির নিজস্ব বাসিন্দারা মানুষের দেহে এদের নতুন বাসস্থান খুঁজে নিয়েছে। আমরা নিত্য নতুন মারণ রোগে আক্রান্ত হচ্ছি।

বাস্তবক্ষেত্রে এমনটা হবার কথা ছিলনা। ২০০২-৩-এ সার্স-কোভ-১-এর অতিমারির পরে ২০০৯ সালে Predict Project বলে একটি প্রোজেক্ট তৈরি করা হয় প্রাণী জগৎ থেকে কি পরিমাণ নতুন ভাইরাস মানুষের দেহে এবং বসবাসের অঞ্চলে প্রবেশ করছে সেটা দেখার জন্য। মানুষ-প্রকৃতি-জীব জগৎ এই স্বাভাবিক ভারসাম্য অপূরণীয়ভাবে ভেঙ্গে যাবার ফলাফল হচ্ছে এই ভাইরাসদের মনুষ্য জগতে প্রবেশ। কিন্তু লস এঞ্জেলস টাইমস-এর রিপোর্ট অনুযায়ী (২.০৪.২০২০) এই প্রোজেক্ট ট্রাম্প প্রশাসন বন্ধ করে দেয় – Trump administration ended pandemic early-warning programs to detect coronaviruses। য়ুহানে করোনার ভয়াবহতা শুরু হবার মুখে “the Trump administration ended a $200-million pandemic early-warning program aimed at training scientists in China and other countries to detect and respond to such a threat.” বন্ধ করে দেবার আগে USAID-এর সাহায্যপুষ্ট এই প্রোগ্রাম ১,২০০ বিভিন্ন ভাইরাসকে চিহ্নিত করে যার মধ্যে ১৬০টি নোভেল করোনাভাইরাস ছিল। য়ুহান সহ পৃথিবীর ৬০টি ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানী এবং টেকনিশিয়ানদের ট্রেইনিং দেওয়াও শুরু করেছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন “শিব ঠাকুরের আপন দেশে / আইন কানুন সর্বনেশে”-র মতো কলমের এক আঁচড়ে এরকম একটি মূল্যবান প্রোজেক্ট বন্ধ করে দিল। বিজ্ঞানের ক্ষতি হল, ক্ষতি হল মানুষের।

২০১৪ সালে কয়েকজন গবেষক EcoHealth জার্নালে (২৩.০৫.২০১৪) এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন “Anthropogenic Land Use Change and Infectious Diseases: A Review of the Evidence” শিরোনামে। এখানে দেখানো হয়েছে – “Land use change has the potential to impact disease dynamics directly and indirectly by changing the abundance, demography, behavior, movement, immune response, and contact between host species and vectors, as well as altering host community composition.”

জমির ব্যবহারে পরিবর্তন (ল্যান্ড ইউজ চেঞ্জ) কারা করলো? কি উদ্দেশ্যে? যে উদ্দেশ্যে (খনিজ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্পদের জন্য) ব্রাজিলের রেন ফরেস্টের ২৫% পুড়িয়ে দেওয়া হয় সে উদ্দেশ্যে। প্রকৃতির উপরে প্রভুত্ব এবং পুঁজির প্রয়োজনে যথেচ্ছ ব্যবহারের বিষময় ফল আমরা ভোগ করছি।

আরও কিছু বিষয় এবার আমরা বিবেচনায় রাখবো।

প্রথম, সোভিয়েত শক্তির পতনের পরে একমেরু বিশ্বের অধীশ্বর হবার যে দর্প এবং ঔদ্ধত্য আমেরিকা এতদিন দেখিয়েছে সেখানে বোধহয় একটু চিড় ধরেছে। এমনকি ইয়ুভাল হারারির মতো রাষ্ট্রপন্থী লেখক তথা ইতিহাসকারও তাঁর টাইম পত্রিকায় প্রকাশিত (১৫.০৩.২০২০) প্রবন্ধের শিরোনাম লিখছেন – In the Battle Against Coronavirus, Humanity Lacks Leadership. এর কদিন বাদেই (২০.০৩.২০২০) ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় আরেকটি বহু আলোচিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল – The World After Coronavirus. এখানে তিনি পরিষ্কার ভাষায় জানালেন – In previous global crises – such as the 2008 financial crisis and the 2014 Ebola epidemic – the US assumed the role of global leader. But the current US administration has abdicated the job of leader. বিবিসি নিউজ-এর (২৪.০৩২০২০) “Coronavirus: What this reveal about US – and its president” প্রতিবেদনে বলা হল – America’s claim to global pre-eminence looks less convincing by the day. While in previous crises, the world’s most powerful superpower might have mobilised a global response, nobody expects that of the United States anymore.

দ্বিতীয়, বিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রের মধ্যে এমন নিবিড় ও নির্লজ্জ সখ্য (যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ছাড়া) যেখানে আন্তর্জাতিক স্তরে বিজ্ঞানীরা বরণ করে নিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতাদের এমনটা খুব সুলভ ঘটনা ছিলনা। একটি নতুন কমপ্লেক্স তৈরি হল – medical-industrial-state-politics complex. স্বাধীন বিজ্ঞান কথাটি সোনার পাথরবাটি হয়ে গেলো। যেমন, অধুনা আবিষ্কৃত রেমডেসিভির (করোনার একেবারে শেষ পর্যায়ের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়) সেটার ওষুধ মূল্যের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ট্রাম্পের America First নীতি।

তৃতীয়, চিন যাতে কোনভাবেই বিশ্বের সামরিক এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্বে ভাগ বসাতে না পারে সেজন্যও করোনা ভাইরাস একটি হাতিয়ার হয়ে উঠছে।

এবং, চতুর্থ, এই ভাইরাসের উৎস যে কর্পোরেট পুঁজির মুনাফা এবং প্রভুত্বের উদগ্র লালসা যেখানে মানুষ থেকে জীবজগৎ, বনাঞ্চল থেকে প্রতিটি প্রাকৃতিক সম্ভার কেবলমাত্র পণ্যায়িত হয় – এ সত্যকে আড়াল করার হাতিয়ারও বর্তমান সময়ের এই ভাইরাস। যে কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি।

প্রাথমিক যে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে তাতে অনুমান করা যায় জনসমাজের ৬০% সংক্রমণ এভাবে ঘটতে পারে। জাপানের এক জাহাজ থেকে উদ্ধার করা টেস্ট-পজিটিভ ১৩ জনের মধ্যে ৪ জনের অর্থাৎ ৩১%-এর কোন উপসর্গ ছিলনা। ভারতে ICMR-এর হিসেব অনুসারে উপসর্গহীন আক্রান্তের সংখ্যা ৮০% পর্যন্ত হতে পারে।

ভাইরাসের প্রজনন সংখ্যা (রিপ্রোডাকশন নাম্বার) দিয়ে এর গতিপ্রকৃতি এবং সংক্রামিত করার ক্ষমতা মাপা হয়। একে বলা হয় R0 – যা দিয়ে বোঝা যায় একজন সংক্রমিত মানুষ ক’জনের মাঝে এই ভাইরাসকে পৌঁছে দিতে পারে। সংক্রমণের সময় সাধারণভাবে এ সংখ্যা ২-২.৫। চিনের য়ুহানে একসময়ে এটা ৪ অব্দি পৌঁছেছিল। এখন এ সংখ্যা ০.৩২-এ এসে পৌঁছেছে। এপিডেমিওলোজির ভাষায় সংখ্যাটি ১-এর নীচে গেলে সংক্রমণমুক্ত বলা যেতে পারে। এখানে আরো পরিষ্কার করে বলা দরকার – এপিডেমিওলোজির ভাষায় সংখ্যাটি ১-এর নীচে গেলে সংক্রমণমুক্ত বলা যেতে পারে না। সংখ্যাটি ১ এর নিচে গেলে সংক্রমণ হয়ে মহামারীর আকার ধারণ করার ক্ষমতা আর থাকে না। ১ এর নিচে গেলে নতুন সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে যায়, নতুন ক্লাস্টার হবার সম্ভাবনা কমে যায়। একে সঠিক অর্থে সংক্রমণ মুক্ত বলা যায় না। Effective Reproduction Number 0.30 মানে আগে যদি R = 2 হয়ে থাকে যেখানে একজন মানুষ দুজনকে সংক্রমণ করছিলো (R = 2 ), এখন উল্টোটা, তিনজন সংক্রমিত ও আক্রান্ত লোক লাগবে একজনকে রোগ ধরাতে গেলে, অর্থাৎ, খুব বড় ক্লাস্টার ছাড়া আর রোগ টিকবে না। সংক্রমণমুক্ত ঠিক নয়। ক্লাস্টারগুলো খুলে গেলে আবার ছোট বড় মহামারী হতে পারে, যেমনটা চিনে কিংবা সিঙ্গাপুরে হচ্ছে।

এখনো অবধি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কোন ধাপেই কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। অতি মারাত্মক ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে সার্স, এইচআইভি-তে ব্যবহৃত অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ এবং ক্লোরোকুইন বা ক্লোরামফেনিকলের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের সম্মিলিত প্রয়োগ ফল দিচ্ছে। অসহায় মানুষ অনেকসময় গোমূত্র পানেও উৎসাহ দেখাতে পারে বৈকি! আমাদের এখানেই দেখেছি যে।

করোনা আমাদের সচকিত করে এ কঠোর সত্যের সামনেও দাঁড় করিয়ে দিল – তথাকথিত গণতান্ত্রিক এবং এক-পার্টি ব্যবস্থার দেশের মধ্যে সত্যিই কি কার্যত কোন ফারাক আছে? ধরে নিচ্ছি চিন করোনার তথ্য গোপন করেছে। স্পষ্টতই আমি য়ুহান ভাইরাসের মতো অবান্তর বিষয় নিয়ে কিছু বলছিনা। নেচার মেডিসিনের মতো পত্রিকায় প্রকাশিত “The proximal origin of SARS-CoV-2” (১৭.০৩.২০২০) প্রবন্ধটি দেখে নিতে অনুরোধ করছি। আরেকদিকে পৃথিবীর “গণতান্ত্রিক” বড়দা আমেরিকার অধীশ্বর ট্রাম্প সাহেব ১৯ মার্চ ঘোষণা করে দিলেন হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন হল “game changer’ – খেলা ঘুরিয়ে দেবার মতো ওষুধ। কি সব্বোনাশ! পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন Anthony Fauci-র মতো আন্তর্জাতিকভাবে মান্য চিকিৎসক – যিনি নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে আমন্ত্রিত সম্পাদকীয় লেখেন, হ্যারিসনের টেক্সট বুকের অন্যতম সম্পাদক এবং ৪০ বছরের বেশি সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাঁকে সর্বসমক্ষে দম্ভভরে স্রেফ চুপ করিয়ে দিলেন। কোন কথাই ফসি বলতে পারলেন না। এমনটাতো হিটলারের বা অন্য কোন একনায়কের আমলে হয়ে থাকে। ভারতেও বোধহয় একথা ভাবা যায়না।

ট্রাম্পের হঠাৎ করে এরকম হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রীতির কারণ কী? জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কল একজন ট্রেইনড বিজ্ঞানী। ট্রাম্প একজন অতি বিত্তশালী ধুরন্ধর ব্যবসায়ী। তিনি ওষুধ নিয়ে এত জানলেন কি করে? ২১ মার্চ টুইট অব্দি করে ফেললেন – HYDROXYCHLOROQUINE & AZITHROMYCIN, taken together, have a real chance to be one of the biggest game changers in the history of medicine. The FDA has moved mountains – Thank You! Hopefully they will BOTH (H works better with A, International Journal of Antimicrobial Agents)। এর পেছনে কাজ করছে অতি সরল বাণিজ্যিক লাভের প্রশ্ন। এবং ট্রাম্পের টুইটের পরে আমেরিকার স্বশাসিত মান্য সংস্থা এফডিএ ব্যতিক্রমীভাবে Emergency Use Authorization (EUA) এ ওষুধগুলোর সীমাবদ্ধ ব্যবহারকে অনুমোদন দিল। আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ ট্রায়াল শুরু করে দিল। এগুলোকে ঠিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলা যাবে কি? নাকি একটি একদলীয় শাসনের আরেকটি রকমফের?

worrldometer-এর তথ্য বলছে (১৭.০৫.২০২০) প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় করোনা সংক্রমণ বোঝার জন্য টেস্টের সংখ্যা ১৮টি দেশে পরপর এরকম –

  • আমেরিকাঃ. ৩৬,১৩৬;
  • ইংল্যান্ডঃ ৩৬,৬৯৬;
  • স্পেনঃ ৬৪,৯৭৭;
  • ইতালিঃ ৪৮,৬৯৮;
  • জার্মানিঃ ৩৭,৫৮৫;
  • ফ্রান্সঃ ২১,২১৮;
  • ডেনমার্কঃ ৭৬,৭৮৫;
  • ইরানঃ ৮,১৯৮;
  • নিউজিল্যান্ডঃ ৪৭৩৫৯;
  • অস্ট্রেলিয়াঃ ৪০,৯২৮;
  • ভিয়েতনামঃ ২,৮২৮;
  • থাইল্যান্ডঃ ৪,০৯৯;
  • সিঙ্গাপুরঃ ৪২,১৩৩;
  • দক্ষিণ কোরিয়াঃ ১৪,৫৮৪;
  • ইজরায়েলঃ ৫৭,৭৩৩;
  • পাকিস্তানঃ ১,৬৯৫,
  • শ্রী লঙ্কাঃ ২,০১৬;
  • ভারতঃ ১৬১৬;
  • এবং বাংলাদেশঃ ১,০৬৫

এ পরিসংখ্যান থেকে পরিষ্কার হবে কতসংখ্যক মানুষের টেস্ট করা হয়েছে প্রতি ১০ লক্ষে, আর কি বিপুলসংখ্যক মানুষ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মতো জনঘনত্বের দেশে “সুপ্ত সংক্রামক” হিসেবে লুকিয়ে থাকবে। পরিণতিতে, লকডাউন পরবর্তী সময়ে আমাদের হয়তো সবচেয়ে খারাপ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এখানে গল্পকথার কোন স্থান নেই, কঠোর পরিসংখ্যান যা দেখাচ্ছে আমরা সেটুকুই বিচার করবো। স্বাভাবিক অবস্থায় বকরোনার কোন ওষুধ নেই। শুধুমাত্র টেস্ট, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এবং আইসোলেশন বা আলাদা করে রাখা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। এজন্যই টেস্টের এত গুরুত্ব।

তারপর?

করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধী ভ্যাক্সিন তৈরির দৌড়ে ৯০টিরও বেশি কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকার মডার্না, চিনের সাইনোবায়োটেক এবং অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের সাফল্য অন্যদের থেকে এগিয়ে। কিন্তু ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা নিয়ে নেচার-এর মতো পত্রিকায় মন্তব্য করা হচ্ছে – “The picture is so far murky” (CORONAVIRUS VACCINE TRIALS HAVE DELIVERED THEIR FIRST RESULTS — BUT THEIR PROMISE IS STILL UNCLEAR – 28.05.2020)

হয়তো কতকগুলো চিরস্থায়ী পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে সামাজিক জগতে, চিকিৎসার দুনিয়ায় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিদ্যমান অবস্থায়। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে “অপর”-এর নির্মাণ। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় (২৩ এপ্রিল, ২০২০) তুরস্কের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুক একটি বিশেষ প্রবন্ধ লিখেছিলেন – “What the Great Pandemic Novels Teach Us”। শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি ছিল যেকোন সংকটের সময়েই মানুষ, বিশেষ করে রাষ্ট্র, একটি অপর বা other খোঁজে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নালের অন্য একটি প্রবন্ধে (“History in a Crisis — Lessons for Covid-19” – ৩০.0৪.২০২০) মন্তব্য করা হয়েছে – One dramatic aspect of epidemic response is the desire to assign responsibility. From Jews in medieval Europe to meat mongers in Chinese markets, someone is always blamed. This discourse of blame exploits existing social divisions of religion, race, ethnicity, class, or gender identity। আমাদের এখানে এই “অপর” কখনো “চিনা ভাইরাস”, কখনো তবলিঘি জমায়েত (যদিও মহারাষ্ট্রে কোন জমায়েত ছাড়াই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে এখনো পর্যন্ত), আবার কখনো সমাজের “আপদ” স্থানান্তরী অসংগঠিত শ্রমিকেরা। একটি “অপর” পেলে রাষ্ট্র তার নজরদারি ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী এবং জনগ্রাহ্য করে তুলতে পারে। এরকম এক আগামী অভিনব নজরদারি ব্যবস্থাকে ইয়ুভাল হারারি বলেছেন “Under the Skin Surveillance”।

আন্তর্জাতিক জগতে এই “অপর” আপাতত চিন। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার (১৮.০৫.২০২০) একটি গুরত্বপূর্ণ খবরের শিরোনাম “Trump is threatening the glonal financial system as he looks to punish China”। নিজের অপদার্থতা ঢাকার অধিক ভালো কী উপায় থাকতে পারে? সংবাদে বলা হচ্ছে – “As the Trump administration seeks to hold China for the spread of the coronavirus and deflect attention from its shortcomings, it is widening its search for sanctions and adding financial dimensions to the retribution it is pursuing.”

বেঁচে থাকা এবং অস্তিত্ব নির্বাহের ক্ষেত্রে পার্সোনাল/সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং হয়তো এরপরে জীবনের স্বাভাবিকতায় পরিণত হবে। আমরা গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে ধীরে ধীরে ভার্চ্যুয়াল জগতে নিবিষ্ট এবং সন্তরণরত একক ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছি। সে অবস্থা আরও শক্তিশালী হবে। সমাজবদ্ধ জীবনও হয়তো আর আগের মতো থাকবেনা, ভেঙ্গে যাবে।

রোগী দেখার ক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন প্রাধান্যকারী জায়গায় যাবার সম্ভাবনা আছে। রোগীকে স্পর্শ করে স্টেথোস্কোপ দিয়ে দেখা হয়তো কম প্রাধান্য পাবে। গার্ডিয়ান পত্রিকায় (১৩.০৫.২০২০) নাওমি ক্লাইনের প্রতিবেদনের শিরোনাম – How big tech plans to profit from the pandemic। গুগল-এর সিইও Eric Schmidt খুব খোলাখুলি বলেছেন – “The first priorities we are trying to do are focussed on telehealth, remote learning, and broadband”।

একইসাথে করোনাকে কেন্দ্র করে রোগ-কেন্দ্রিক ভার্টিকাল প্রোগ্রাম সামনের সারিতে থাকবে, একেবারে পেছনে চলে যাবে হয়তো সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ধারণা। হাই-টেক মেডিসিন কর্পোরেট পুঁজির নতুন এক লীলাক্ষেত্রের জন্ম দেবে।

বর্তমান সংকটে নেতৃত্ব দেবার ভূমিকায় কোন দেশ ছিলনা। ফলে আশ্চর্য হবোনা যদি এক-মেরু বিশ্ব ভেঙ্গে গিয়ে একাধিক মেরু তৈরি হয়। তাহলে দুর্বল দেশগুলোর দর কষাকষি করার ক্ষমতা বাড়বে। এতে বিশ্ববাসীর উপকার হবার সম্ভাবনা আছে।

এগুলো কতকগুলো যৌক্তিক অনুমান। তার আগে মানুষকে বাঁচতে হবে। অঙ্গুলিমেয় কিছু বিলিয়নেয়ারের মুনাফার উদগ্র লালসা এবং প্রভুত্বের ধর্ষকাম মানসিকতা মানুষ এবং জীবজগৎ ও প্রকৃতির মধ্যেকার ভারসাম্য চিরদিনের জন্য বিলীন করে দিয়েছে। আরও অনেক বিপজ্জনক ভাইরাস ও অণুজীবের আক্রমণের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে। জানিনা নতুন শিশুরা কিভাবে আত্মরক্ষা করবে।

তবে ভাইরাসকে নিয়ে সহবাস করা আমাদের ভবিষ্যৎ পরিণতি হতে যাচ্ছে একথা বলার জন্য পণ্ডিত হবার প্রয়োজন নেই। প্রসঙ্গত মনে পড়বে কাম্যুর প্লেগ উপন্যাসের কথা। সে উপন্যাসের মূল চরিত্র ডঃ রু (Rieux) ফ্রান্সের কাল্পনিক ওরান শহরের মহামারি প্লেগের চিকিৎসা করতে গিয়ে বলছেন – “I have no idea what’s awaiting me, or what will happen when this all ends … For the moment I know this: there are sick people and they need curing.”

মানুষ যত্ন চায়, মমতা চায়, সহমর্মিতা চায়। তাই “what will happen” জানা না থাকলেও আমাদের কাজ করে যেতে হবে। এমনকি ভারত সরকারের করোনা অতিমারির জন্য ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের মাত্র ০.৭৫% (১৫,০০০ কোটি টাকা) স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ হওয়া সত্ত্বেও।

এখানেই চিকিৎসকের দায়িত্ব, দায়িত্ব সংবেদী সমাজের, দায়িত্ব মানুষ-মুখী রাষ্ট্রের।

– ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য

(চিকিৎসক, গবেষক ও জনস্বাস্থ্য কর্মী)

Related News

Back to top button