উত্তর দিনাজপুরের নদী কাহিনী (দ্বিতীয় পর্ব)
কুলিক, মহানন্দা, নাগর, টাঙন — প্রধান এই নদীগুলি ছাড়াও জেলার বুকে প্রায় ২৮টি নদীর চিহ্ন। তবে বেশিরভাগ নদীরই আজ প্রবাহ নেই। হাতে গোনা কয়েকটি নদীই আজ বর্তমান। তবে এক সময় এই এলাকা ছিল নদী কেন্দ্রীক। বড়বড় সওদাগরি নৌকা নোঙর করত এই জেলায়। নদী পথে চলত ব্যবসা বাণিজ্য। কিন্তু আজ সেকথা শুধুই ইতিহাস।
কুলিক নদী নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব।
Bengal Live রায়গঞ্জঃ যখন কুলিক তার পূর্ণ যৌবন পর্বে তখন ব্যবসা বাণিজ্যের সমস্ত কাজ কুলিক নদী পথেই হত। বড় বড় সওদাগরি নৌকা কুলিক নদীর বন্দর ঘাটে এসে নোঙর করত। বর্তমানে নদী সোজা পথে বইছে। ফলে পুরাতন নদীর বন্দর সংলগ্ন বাঁকটি এখন পরিত্যক্ত। কিন্তু অতীতে এই নদী ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্যের ফলেই রায়গঞ্জ বন্দর এই জেলার আদি জলপথ রূপে পরিচিত।সেই সময় বন্দর সংলগ্ন এলাকায় কুলিক নদীর বেশ কয়েকটি ঘাট ছিল। তার মধ্যে বিখ্যাত ছিল বন্দর ঘাট, গোসাই ঘাট, মুনসেফের ফাঁড়ি।
নদীর পশ্চিম পাড়ে ব্যবসায়ীদের নৌকাগুলি এসে যেখানে দাঁড়াতো সেখানে একটি কালী মন্দির ছিল। ব্যবসয়ীরা প্রথমে বন্দরঘাট কালী বাড়িতে পূজা দিয়ে আদি কালী বাড়িতে পূজা দিতেন। তারপর মালপত্র বিকিকিনির জায়গা বন্দরের গুদরি বাজারে অবস্থিত আদি দুর্গামন্দিরে পূজা দিয়ে ব্যবসা শুরু করতেন। এখানকার ধান, পাট, চাল শুধু ভারতে নয়, ভারতের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হত। চট দিয়ে তৈরি ধোকড়ার জন্য রায়গঞ্জের খ্যাতি ছিল সুদূর চীন পর্যন্ত।
রায়গঞ্জের ধোকড়া চীনের বাজারে বিক্রির খবর কোম্পানির শাসকরা তাদের দলিলে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন সেই সময়েই। পাট কেনার জন্য রেলী ব্রাদার্স ব্রিটিশ আমলের সূচনা থেকেই ব্যবসা শুরু করেছিলেন রায়গঞ্জে। দেশভাগের পর কুলিক নদীর গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। একদা ব্যবসা বাণিজ্যের সূত্রে এই নদী ধরেই মহানন্দা, গঙ্গা হয়ে দেশ তথা দেশের বাইরে দিনাজপুরে উৎপন্ন বিভিন্ন জিনিসপত্র যেমন ধান, পাট, মাশকলাই, পেঁয়াজ, লঙ্কা রপ্তানি করা হত।
আরও পড়ুনঃ উত্তর দিনাজপুরের নদী কাহিনী। (প্রথম পর্ব)
সিপাহী বিদ্রোহের আগে থেকেই রায়গঞ্জের কুলিক নদী সংলগ্ন বন্দর অঞ্চলটি দিনাজপুর জেলার অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। কুলিক নদীর উপর দিয়ে নৌকা সহযোগে পণ্য সামগ্রী আমদানি ও রপ্তানি ব্যবস্থা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই একদা এই কুলিক নদী পথে দূর দূরান্ত থেকে ক্রেতা বিক্রেতারা হাজির হতেন রায়গঞ্জে। কিন্তু সে সব আজ উধাও। আজ নদীর বির্স্তীর্ণ এলাকা জুরে তৈরি হয়েছে ধানক্ষেত, কোথাও আবার গজিয়ে উঠেছে ঘড় বাড়ি, দোকানপাট।
নব্বইয়ের দশকে এক ভয়াবহ বন্যায় কুলিকের জলে প্লাবিত হয়েছিল রায়গঞ্জ শহরের একাংশ। সেই সময় বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন রায়গঞ্জবাসী। এর পর নদীবাধ তৈরি হলে বন্যার হাত থেকে নিস্তার পেলেও নদীর বিস্তর ক্ষতি হয়। জলাশয় থেকে উৎপন্ন হওয়ার কারণে কুলিক নদী খরস্রোতা নয়। ফলে নদীর তলদেশ অগভীর হতে থাকে। বৃষ্টির সময় হঠাৎ বেশি জল চলে এলে বন্যার সৃষ্টি হয়। নদীর দুইপাশে মানুষের ক্রীয়াকর্ম যেমন কৃষিকাজ, বাড়িঘড় গড়ে তোলা ছাড়াও নিজেদের সুবিধে মতন নদীকে ব্যবহার করার ফলেও নদীর ক্ষতি হয়েছে বহুলাংশে।
কৃষিক্ষেত্রে প্রচুর পলি, বালি বৃষ্টির জলের সাথে নদীতে জমা হয়। যেহেতু নদী বৃষ্টির জলে পুষ্ট তাই সারা বছর সমপরিমাণ জল প্রবাহিত হয় না। শীতকালে নদীটি শীর্ণকায় নদীতে পরিণত হয়। প্রায় হেঁটেই নদীর একপাশ থেকে অন্য পাশে যাতায়াত করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এর ফলে নদী তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে।