বেঙ্গল লাইভ Special

নিজের যত্ন নিন: সন্তানকে বড় হতে দিন।

আজকের বাবা-মা রা সন্তানের প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করে সন্তানের বিপদ ডেকে আনছেন না তো ? যাকে আপনি যত্ন বা ভালোবাসা বলছেন, তাতে আপনার সন্তানের আদতে ক্ষতিই হচ্ছে না তো? একটু ভাবুন।

এভাবেও ভাল থাকা যায় ! মানুন, না মানুন, অসুখী মধ্যবিত্তরা পড়ে দেখুন

Bengal Live স্পেশালঃ যদি সন্তানকে মানুষ করতে চান তাহলে নিজের যত্ন নিন। আমার এক চেনা আত্মীয়া আছেন তার একমাত্র ছেলেটি ক্লাস টেন এ পড়ে। সিবিএসসি বোর্ড, সুতরাং মায়ের ধারণা ছেলের খুব চাপের মধ্যে আছে। যদিও ছেলেটিকে দেখে কিন্তু সেরকম কিছুই মনে হয়না। সে নিজের পড়াশোনা, টিভি দেখা, গান-বাজনা সব কিছুর মধ্যে একটা সুন্দর সামঞ্জস্য খুঁজে নিয়েছে। পরীক্ষায় অসাধারণ নাম্বার না পেলেও খুব একটা খারাপ নম্বর সে পায় না, এ নিয়ে তার মায়ের মধ্যেও কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু এই এক সমস্যা। একটি মাত্র সন্তান, তাই ছেলে কোন কিছু ভাবার আগেই মা অনেক কিছুই ভেবে ফেলে।

ইমোজির মানে না বুঝে ব্যবহার ? সাবধান ! ইমোজির পেছনে যৌনতার ব্যঞ্জনা

ছেলে কি রঙের জামা পড়বে,কোন জুতো পড়বে এমনকি তার স্কুলের ব্যাগ এর রং কি হবে সেসব নিয়ে মায়ের গবেষণার শেষ নেই।এনিয়ে মাঝেমধ্যেই ছেলের সাথে মায়ের ঝগড়াঝাটি এমনকি হাতাহাতিও হয়ে যায়। কোন শিক্ষকের তার প্রতি কোন অভিযোগ নেই। তার খাওয়া দাওয়া নিয়ে সমস্যা নেই। তার খারাপ বন্ধু বান্ধব নেই। নেই কোনো খারাপ অভ্যেস। তাই যখন শিক্ষকরা শোনেন যে মায়ের সঙ্গে তার এরকম ঝগড়াঝাঁটি হয় মাঝে মাঝেই, তারা ভীষণ অবাক হয়ে যান।

উত্তর দিনাজপুরের দ্বিতীয় প্রাচীন স্কুল মারনাই শরচ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়

তার বাবা-মা ঠিক করেছে তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবে। তার আগে তারা আমার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলে নিতে চায়। তাদের সাথে প্রায় 30 মিনিট গল্প করার পর আমি যখন হেসে বললাম যে আসলে ‘আপনাদেরই সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো উচিত’।তাদের মুখ চোখ দেখে বুঝলাম তারা মোটেও খুশি হননি।আমি তখন তাদের বললাম “দেখুন আপনাদের খুশি করার দায়িত্ব কিন্তু আমার নয়, আমার দায়িত্ব সত্যি কথা বলা এবং আপনাদের সঠিক পথটা দেখানো।একজন ডাক্তারের কাছে আপনি যা শুনলে খুশি হবেন সেটা শোনার জন্য যান ? নাকি আপনার সমস্যার কারণ জানার এবং সমস্যা দূর করার পদ্ধতি গুলো জানার জন্য যান? ভালো করে ভাবুন।“

তারা পরবর্তী সেশনে তাদের ছেলেটিকে নিয়ে আসবেন,বলে গেলেন। তাদের যাবার পর আমার মনে হলো আমিও তো পিতা।যদিও আমার সন্তানের বয়স খুব কম। পরবর্তীতে আমিও কি তার ইচ্ছে,অনিচ্ছে, পছন্দ, অপছন্দ নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করব?আমার মনে হল এসব ক্ষেত্রে মায়েদের ভূমিকা বেশি হয়, কারণ তারা সন্তানের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকেন।সন্তানের সব মানসিক পরিস্হিতির খবর সবার আগে মা- ই তো পান।

এভাবে বাচ্চাদের খাওয়াবেন না, বুদ্ধি লোপ পাবে, ভবিষ্যৎ গড়তে খাদ্যাভ্যাস পাল্টান

সেক্ষেত্রে দেখা যায়, যেসব মায়েরা সন্তানের সব ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত প্রটেক্টিভ( সাবধানী বলা যায় ) হন, অর্থাৎ একটা বয়সের পরও সন্তানের সব ব্যাপারেই অনর্থক নাক গলান( এই ভাষাটা ব্যবহার না করে পারলাম না। আপনার সন্তান আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়,সে একটি স্বাধীন প্রাণ, সবসময় মনে রাখবেন), তাদের ক্ষেত্রে মা ও সন্তানের সম্পর্ক এমন এক অদ্ভুত তিক্ততায় চলে যায় যে, সন্তানের অন্যান্য স্বাভাবিক সম্পর্কগুলো তে তার প্রভাব আসতে শুরু করে। তার ফলে সবক্ষেত্রেই কিন্তূ দোষের ভাগিদার হতে হয় মা-কেই।যখন মায়ের বয়স কম থাকে ,তখন এসব বিষয়ে সমস্যা তৈরি হয় না, কিন্তু সন্তান যখন তার সংসার গড়ে,মা প্রৌঢ়া এবং বৃদ্ধা হন, তখন তাকে ভীষণ এক মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

আপনার সন্তান আপনারই সন্তানঃ 

অনেক মা-ই ভাবেন, সন্তান একটু বড় হয়ে গেলে, সে নিজের পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করতে শুরু করলে সন্তানের লাগামের রাশ তার হাত থেকে চলে যাচ্ছে। আপনার সন্তান তো ঘোড়া নয়। সে মানুষ। প্রথম ছয় মাস বয়সে সে আপনার বুকের সঙ্গে লেগে থাকত। আপনার দেয়া অমৃত পান করে সে পৃথিবী কে চিনতে পেরেছে। পরবর্তীকালে যখন হাঁটতে শিখলো তার হাটা শেখাকে আপনি কি বাধা দিয়েছেন ? কেন দেননি? সে হাঁটতে শিখেছে,তার মানে সে তো আপনার বুকের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। দেননি, কারণ এটাই চলমান জীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেই একই প্রক্রিয়ায় সে পৃথিবী কে চিনতে শিখেছে ; পৃথিবীর সঙ্গে নিজের সম্পর্ক স্থাপন করতে শিখেছে; শিখেছে নিজের পছন্দ-অপছন্দ জাহির করতে। সে যখন হাঁটতে শিখেছিল, বারবার করে সে পড়ে যেত। জীবনে চলার পথে দু-একবার হোঁচট না খেলে কেউ সোজা হয়ে চলতে শিখতে পারে না। একটু ভালো করে চিন্তা করুন। বুঝতে পারবেন আপনি আসলে আপনার সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ, ঠিক-ভুল সবকিছু শুধু নিয়ন্ত্রণই করছেন না; তার চলার পথে, বেড়ে ওঠার পথে বারবার বাধা সৃষ্টি করছেন। তাকে নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তৈরি করার সুযোগ না দিলে, সে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে। আপনি কিন্তু সবসময় থাকতে পারবেন না, তার পাশে। তার বয়স যখন চল্লিশ হবে, সে সময় তার কর্মক্ষেত্রে সে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে গিয়ে সমস্যায় পড়ে, মনে রাখবেন ,সেটা আপনার জন্য। পারবেন নিজেকে ক্ষমা করতে?

বন্ধু-বান্ধবী ও যৌনতা নিয়ে শিশুর মনের কৌতুহল কীভাবে সামলাবেন বাবা-মা ?

সন্তানের পেছনে থাকুন, পাশে বা আগে নয়ঃ 

আমরা যদি বংশতালিকা তৈরি করি, তাহলে পিতার পাশে মাতা বসে। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের সন্তানের নাম বসানো হয়।পূর্ববর্তী পর্যায়ে বসানো হয় ঠাকুর্দা-ঠাকুরমা কে। আপনার সন্তানের সাথেও তেমনি আচরণ করুন। তার পাশের জায়গা তার বন্ধুর এবং পরবর্তীতে তার জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর। আপনার কাজ তার পেছনে থাকা। তাকে মানসিকভাবে সঙ্গ দেওয়া।আপনারা পেছনেই আছেন,এই বিশ্বাস তৈরি করে দেওয়া। তার প্রতিটি সিদ্ধান্তের আগেই যদি আপনি আপনার সিদ্ধান্তগুলো তার উপর চাপিয়ে দেন, সেটা কি অন্যায় হবে না। ধরুন আপনি রান্না করছেন, আপনার পাশে কেউ যদি দাঁড়িয়ে ক্রমাগত বকতে থাকে, এবার এটা দাও, এবার সেটা দাও; আপনি বিরক্ত হবেন কিনা বলুন?

নিজের যত্ন নিনঃ

আমাদের বেশিরভাগেরই এখন একটি করেই সন্তান। আর তাই পিতা-মাতার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে যায়, তাকে কী করে আরো বেশি, বেশি ভালো রাখা যায়। এই চেষ্টায় আমরা নিজেদের ছোট-ছোট ভালো-মন্দ লাগাগুলিকে অনায়াসে বিসর্জন দিয়ে থাকি, কোনো এক অনন্যসুন্দর ভবিষ্যতের আশায়। তারপর সব দোষ গিয়ে পরে বড় হয়ে যাওয়া সন্তানটির ওপর—তোর জন্য আমি এটা করতে পারিনি, সেটা করতে পারিনি, এই স্যাক্রিফাইস করেছি।তারপর সে যখন বলে “ কে করতে বলেছিল স্যাক্রিফাইস? আমি বলেছিলাম?” তখন পায়ের নিচের থেকে মাটি সরে যায়। পিতা-মাতা এক কষ্ট নিয়ে বাঁচে, সন্তানও বয়ে বেড়ায় সেই কষ্টের দায়ভার। তাই, শুধু সন্তানের জন্যই না বেঁচে একটু নিজের জন্যও বাঁচুন। একটু সাজুন, একটু আনন্দ করুন, সিনেমা দেখুন, ঘুরুন দুজনে একসঙ্গে, গল্প করুন হাত ধরে পার্কের বেঞ্চে। শরীরের সাথে সাথে একটু মনেরও যত্ন নিন। সন্তানকে তার মত করে একটু একা থাকতে দিন মাঝেমধ্যে।

শৈশবেই নৃশংসতার পাঠ ! পাঁচ বছরের তাতান বাবার গলায় ধরলো ছুরি

ভারতীয় সমাজের সুবিধে:অসুবিধেঃ 

পৃথিবীতে যে কয়েকটি দেশ আছে, যেখানে বিবাহের পরেও সন্তান বাবা-মায়ের সাথে থাকে,তার মধ্যে ভারত অন্যতম। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ও যৌথ পরিবারের ধারণা বহু পুরোনো এবং প্রশংসিত। এর পেছনে আর্থ-সামাজিক কারণ নিশ্চয় অনেক আছে, কিন্তু আমার মনে হয় , তার চেয়েও বেশি আছে জীবনে ব্যালেন্স বা সমতা রাখার শিক্ষা।মহামতি চাণক্য বলে গেছেন ষোলো বছরের পর থেকে সন্তানের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হয়। কিন্তু আমরা বাবা-মা রা আজীবন সন্তানদের সাথে এমনভাবে আচরণ করি, যেন সে দুধের শিশুটি থেকে গেছে, জন্মের চল্লিশ বছর পরও। এমনও ঘটনার সঙ্গে আমি পরিচিত, যেখানে বিবাহিত ছেলের বেডরুমে যখন তখন ঢুকে পড়াকে তার মা অতি স্বাভাবিক বলেছেন ,এমনকি দরজা বন্ধ দেখলে তৎক্ষণাৎ সেটি খুলে দেবার জন্য বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। সেই মহিয়সী মায়ের মনে হয়েছে আমি আমার ছেলের ঘরে কেন দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকব ? এ অতি অস্বাভাবিক ব্যাপার। তার যুক্তিগুলো শুনে তার উত্তরে আমি আর কিছু বলতে পারছিলাম না। আমার ভীষণ হাঁসি আর কান্না একসঙ্গে পাচ্ছিল।

স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকঃ

আমার স্কুলজীবনের চেনা একটি ষোলো বছরের ছেলে তার স্কুলের এক বান্ধবীকে, তার নিজের হাতে রাত জেগে আঁকা সেই বান্ধবীর ছবি জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল। ছেলেটির আঁকার হাত ছিল মারাত্মক ভাল। কিন্তু এই ঘটনার পর ছেলেটিকে তার মা ভীষণ বকাবকি করে, এই বলে যে ,সে যতখানি সময় সেই ছবি একে নষ্ট করেছে,তাতে তার মাধ্যমিকের ফল খারাপ হয়ে যাবে। তার মা ছেলেটিকে দুদিন ঘরে আটকে রেখেছিল। বলেছিল এমন অস্বাভাবিক মানসিকতা এই বয়সে তার কেমন করে হয়েছে?মেয়েদের প্রতি তার এত আকর্ষণ কেন? তার বাবা কিন্তু ছেলেটির পাশে দাঁড়িয়েছিল। ছেলেটি এখন একটি আর্ট কলেজের প্রধান দায়িত্বে আছে।বিয়ে করেছে।এক ছেলে। সেদিন দেখা হয়েছিল, সেই মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করতে বললো, মেয়েটি এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় তার কেরালিয়ান স্বামীর সঙ্গে থাকে। মেয়েটির দুটি সন্তান হয়েছে,যমজ।অবিকল একই দেখতে। তাদের বন্ধুত্ব এখনও অটুট। ফেসবুকে -হোয়াটসআপ এ নিয়মিত কথা হয়। ছেলেটি আমাকে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করেছিল “ আচ্ছা দাদা, আমাকে বর্ণালী ওর মেয়ে দুটোর ছবি এঁকে রাখতে বলেছে।এবার পুজোয় এসে নেবে। তুমিই বল তো, দুটো ছবিই আঁকবো, নাকি একটা এঁকে একটা জেরক্স করে নেবো?“এবারও আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না।

লেখকঃ
অমিতাভ দাষ।
Child and Adolescent Counsellor.
Child psychotherapist.
যোগাযোগ:7001596757

Related News

Back to top button