বেঙ্গল লাইভ Special

শৈশবেই নৃশংসতার পাঠ ! পাঁচ বছরের তাতান বাবার গলায় ধরলো ছুরি

জীবনের সবচেয়ে দামী সময় শৈশব।শৈশব তৈরি করে একটি মানুষের সারাজীবনের ভিত। কিন্তু আধুনিক জীবনযাপন ও তথ্যের বোঝার ভার আপনার শিশুর কেড়ে নিচ্ছে শৈশব। তার শৈশব বাঁচান। লিখছেন মনস্তাত্ত্বিক অমিতাভ দাষ । তিন কিস্তিতে। আজ প্রথম পর্ব।

Bengal Live স্পেশালঃ গভীর রাত। মাঝে পাঁচ বছরের তাতান ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু মানসী আর শুভর চোখে ঘুম নেই। আজ দুপুরেই মানসীর ফোনে ইউটিউবে কার্টুন দেখতে দেখতে কোনোভাবে একটা লিংক খুলে তাতান দেখে ফেলেছে মধ্যপ্রাচ্যে এক জঙ্গিগোষ্ঠীর ভিডিও। একজন ইউরোপিয়ানকে কিভাবে গলায় ছুরি চালিয়ে ক্যামেরার সামনে মেরে ফেলেছে এক জঙ্গি কমান্ডো । তাতানও একটা ছুরি নিয়ে পেছন থেকে তার বাবার গলায় ধরেছিল। তারপর মধ্যবিত্ত সংসারে যা হয়।একে অন্যকে দোষারোপ। বংশপরিচয় ইত্যাদি তুলে তুমুল কথা কাটাকাটি, ঝগড়া এইসব আর কি। মধ্যেখানে আজ সন্ধ্যায় এগরোল বানানোর কথা ছিল মানসীর।পড়ে থাকলো। তাতানও শেষ অবধি ভালো করে বুঝতেই পারলো না । সে কী ভুল করলো ? কারণ তার সাথে আর কেউ ভালোভাবে কথাই বলেনি তারপর।

একটু গভীরভাবে ভাবলে আমাদের কারোরই ঘুম হওয়া উচিত নয়। আমার আপনার সন্তান যা দেখছে, যা শুনছে সেইসব কিছুই কি তার বয়সের পক্ষে উপযুক্ত? ভাবার সময় এসেছে এইবার। মোবাইল-ইন্টারনেট , ফেসবুক, ইউটিউব এসব তো পরের প্রশ্ন। আমরা বড়োরাই বাড়িতে যেসব আলোচনা করি বা যেভাবে জীবনযাপন করি, সেসব কি আমার শিশুটিকে সঠিক রাস্তা দেখাচ্ছে। শিশু আমাদের কাছে ভাষা শিখেছে, খাওয়া শিখেছে, কথা বলা আর কথা বলার ধরণ শিখেছে। কাজেই জীবনযাপনও যে সে আমাদের কাছেই শিখবে, সে আর আশ্চর্য কী ?

একটি শিশু জন্মানোর পরই তার মধ্যে বিভিন্নরকম আকুইসিশন ডিভাইস (AD) কাজ করতে শুরু করে, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করার জন্য। তার পঞ্চ-ইন্দ্রিয় ক্রমে ক্রমে তাকে জানায় অনুভূতিগুলো কিভাবে গ্রহণ করতে হবে। সে চুম্বকের মত আকর্ষিত হতে থাকে শব্দ,বর্ণ, স্বাদ,স্পর্শ আর গন্ধের মায়াজালে।

শিশু যা দ্যাখে সেটাকেই স্পর্শ করে, মুখে দিতে চায়, স্বাদ বোঝার চেষ্টা করে, পছন্দ না হলে ফেলে দেয়, সেটা আবার কুড়িয়ে নেয়, আকৃতি বুঝবে বলে। আবার ফেলে দেয়। আবার কুড়িয়ে নেয়, বোঝার চেষ্টা করে আরো কিছু কি বাকি আছে সেটা চিনতে?
শিশু যখন শব্দ শোনে, প্রথমে তার উৎস বোঝার চেষ্টা করে। সেটা পরিচিত না অপিরিচিত শব্দ জানার চেষ্টা করে। পার্থক্য করার চেষ্টা করে মৃদু শব্দ, জোরে শব্দ। আলাদা আলাদা মানুষের আলাদা আলাদা গলার আওয়াজ। এইভাবে তার স্মৃতিতে সঞ্চয় করে নেয় শব্দের সঙ্গে বস্তুর, ব্যক্তির সম্পর্ক।

সে যখন স্পর্শ করে, তখন সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অতি কৌতূহলী বিজ্ঞানীর মত। কোনো বস্তুর সম্পূর্ণ রূপ-রস-বর্ণ-সুগন্ধ সবটুকু না জানলে যেন তার শান্তি নেই। তার জানার চেষ্টায় ফাঁকি নেই কোনো। প্রকৃতি তাকে পৃথিবীতে টিঁকে থাকার যে গুরুদায়িত্ব দিয়েছে, তার জন্য সবকিছু জানা, শেখা তার অবশ্যপ্রয়োজন।

তাই সে জানতে চায় বড়দের থেকে, শিখতে চায় তারা কী করছে? কখন করছে? কিভাবে করছে? কিন্তু এই বড়দের জগৎ যে এক অদ্ভুত সংকটময় জগৎ সেটা সে জানবে কিভাবে? আমরা বড়রা শিখে গেছি কিভাবে মিথ্যা কথা বলতে হয় নিজেকে বাঁচাতে। কখনো ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ফোনে বলে উঠি “হ্যাঁ! এইতো, আমি রাস্তায় বেরিয়ে গেছি”। কখনো বা গাড়ি চালাতে চালাতে ব্রেক কষে পথচারীকে গালি দিয়ে উঠি। কখনো বাচ্চাকে কোনোকিছু প্রমিস করে সেটা করতে ভুলে যাই। কখনো বাচ্চাটির স্কুলের ফাংশানে উপস্থিত না থাকতে পারার অপরাধবোধ কাটাতে তার জন্য কিনে আনি দামী উপহার। আমার শিশু সব লক্ষ্য করে, সব দ্যাখে, সব শোনে।

এসব দেখেশুনে কখনো কখনো তাই সে হয়ে যায় ভীষণ দিকভ্রষ্ট (কনফিউসড)। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল বিচার করার ক্ষমতা তো তার হয়নি এখনো! তাই কখনো সে ঠিককে ভুল আর ভুলকে ঠিক ভেবে বসে, কখনো সে নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে তার না বুঝতে পারার বোধশক্তিহীনতার জন্য। নিজেই নিজেকে তকমা দিয়ে বসে একজন হেরে যাওয়া মানুষ হিসেবে। হ্যাঁ! শৈশবেই।

আধুনিক জটিল জীবন শিশুদের জীবনেও বপন করে দিয়েছে এক জটিল বটবৃক্ষ। তার জট, ঝুরি সব দিয়ে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে সবুজ খোলা মাঠের শিশুমনকে। মিশিয়ে ফেলছে অন্ধকারে ধীরে ধীরে।অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের চোখের সামনেই কিন্তু তাদের অজান্তে শিশু হারিয়ে ফেলেছে তার শিশুমন। অনেক স্মার্ট হতে গিয়ে তার মনে চাপ পড়ছে বয়সের অনুপযোগী জটিলতার।কখনো কখনো আমরা বাবা-মারাই না বুঝেই এই রাস্তা তৈরি করছি তার জন্য, যে রাস্তায় সে চলতে চলতে হারিয়ে ফেলেছে তার শৈশব।

একটি শিশুর জন্মের সাথে সাথেই আরো দুজন মানুষের জন্ম হয়। তার পিতা ও মাতা। এতদিন তো শুধু তারা পুরুষ ও নারীই ছিলেন। কিন্তু এখন থেকে তারা মা ,বাবা। এই নতুন জন্মের সাথে সাথে বেড়ে যায় দায়িত্বও। শুধু শারীরিক পরিশ্রমই নয়, মানসিক চাপও।নিজেদের জীবনযাপনের ছন্দও। যাকে আমরা পৃথিবীতে নিয়ে এসেছি এত কষ্ট করে,তার জন্য তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের পাল্টানোরও প্রয়োজন হতে পারে।

শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য, চরিত্র গঠনের জন্য, সবচেয়ে বেশি ভূমিকা তার পিতা -মাতার, একদম প্রথমে বিশেষ করে মায়ের, শিশু মনস্তত্ত্বের ভাষায় যাকে বলা হয় প্রাথমিক যত্নদাত্রী (primary caregiver)। এই প্রাইমারি কেয়ারগিভর এর বেশিরভাগ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই কিন্তু শিশু নকল করতে করতে বড় হয়। তার কথা বলা, হাঁটার ধরণ, তার মুদ্রাদোষ ইত্যাদি।এমনকি জন্মগত বা জিনগত বৈশিষ্টকেও ছাপিয়ে যায় তার অনুসরণগত বৈশিষ্টগুলো। পিতার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। তার জীবনযাপন,তার কথাবার্তা, পরিবারের অন্যদের সাথে তার ব্যবহার, এমনকি তার কথা বলার ধরনও কিন্তু শিশুকে প্রভাবিত করে।

তাই খুব ছোট বয়স থেকেই লক্ষ্য করা উচিৎ যে আমাদের আচরণগত প্যাটার্নগুলি ঠিক আছে তো!! আমরা শিশুটির নকল করার জন্য ঠিকঠাক উদাহরণ হয়ে উঠছি তো!!

শিশু যখন হাঁটতে শেখেঃ বয়স

দুই-তিনঃ

একঃ প্রাথমিকভাবে শিশু বাবা-মায়ের নির্দেশ অনুসরণ করে। এটা কোরো না।ওটা কোরো না।খুব ভালো। খুব সুন্দর। গলার আওয়াজের তারতম্যের মাধ্যমে সে ঠিক ,ভুল বুঝতে পারে। তাই শিশুকে খুব সহজভাবেই নির্দেশ দেওয়া উচিৎ।পরিষ্কারভাবে ঠিক বা ভুলের পার্থক্য বোঝানো উচিৎ।“এটা কেন করলে”, “এটা ঠিক করনি”, এভাবে বললে তার মধ্যে সঠিক নির্দেশ পৌঁছায় না। বরং তাকে বলা উচিৎ সোজাভাবে “এটা করবে না।এটা ভুল”।সে ভাল কিছু করলে তাকে ভালো, মন্দ কিছু করলে ,পরিষ্কার ভাবে মন্দ বলা উচিৎ।এতে তার মধ্যে কনফিউশন তৈরি হবে না।

দুইঃ তাকে সিদ্ধান্ত নিতে শেখান।কিন্তু তাকে বেশি অপশন দেবেন না। অনেক জিনিস একসঙ্গে দেবেন না। যখন রং চেনাবেন, একবারে সাদা, কালো ,লাল, হলুদ, সবুজ একসাথে দেবেন না। আগে সাদা আর কালো চেনান। পার্থক্য বোঝান।অথবা লাল ও সবুজ। কিন্তু কখনোই একসঙ্গে চার-পাঁচটি নয়।একসাথে অনেক রকম খেলনার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। একটি খেলনা দিন আগে। সেটি নিয়ে সে খেলুক কিছুদিন। সেটাকে জানুক,বুঝুক, ভাঙুক —তারপর আরেকটি।তার চোখের আড়ালে রাখুন অন্য সব একই রকম চয়েসগুলি। একমুখি মানসিকতা তৈরি করুন প্রথম থেকেই। পরে দেখবেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে আপনারই সুবিধে হচ্ছে।

তিনঃ তাকে সব কাজই করতে বাধা দেবেন না। ছোট ছোট কাজ করান তাকে বুদ্ধি করে। বলুন বড় চামচটা নিয়ে এসো ওই ঘর থেকে। ছোট গ্লাসটা বাবাকে দাও। সে কোনো জেদ করলে, তাকে সামনে বসিয়ে বোঝান, কেন সে যেটা চাইছে, সেটা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণগুলো বুঝিয়ে বলুন।শুধু বকাঝকা করবেন না।বোঝানোর চেষ্টা করুন তাকে। এমনকি সে যখন কিছু চাইছে, জিজ্ঞেস করুন , কেন সে সেটা চাইছে? সে কি করবে সেটা দিয়ে? সেটা করলে তার কি কাজ হবে। অর্থাৎ সে যাতে বুঝতে পারে প্রতিটা চাওয়ার পেছনে একটা কারণ থাকে, সেটার ব্যবহার থাকে।

চারঃ ফোন তার চোখের আড়ালে রাখুন। বিছানায়, খাবার সময় যেখানে সেখানে ফোন ঘাঁটবেন না। সে যাতে বোঝে ফোন একটা গুরুত্বপূর্ন জিনিস। তার ছোট্ট পুতুল বা গাড়িটির মত খেলনা নয়, যা সবসময়ে হাতে থাকে।সে কাঁদলে শান্ত করার জন্য ফোন ধরিয়ে দেবেন না। ভুলেও ভাববেন না ফোন ব্যবহার করলে আপনার শিশু দারুন বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে উঠবে। ফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিন তাকে আকৃষ্ট করবেই। মাঝে মাঝে তাকে গান বা ভিডিও দেখাতে পারেন।কিন্তু এই মারণাস্ত্র তার হাতে তুলে দেবেন না কখনোই।

পাঁচঃ বাজারচলতি বিজ্ঞাপনের মোহে ভুলে তাকে সিনথেটিক খাবার, লম্বা হবার,শক্তিশালী হবার খাবার না দিয়ে সাধারণ বাড়িতে বানানো খাবার খাওয়ান। পুষ্টিকর কিন্তু সুস্বাদু খাবার যে বাড়িতেই পাওয়া যায়, সেটাই শেখান তাকে। ইউটিউবে প্রচুর মেনু পাবেন যা সহজে বাড়িতে তৈরি করা যায়।নিজেরাও রেস্তোরার খাবার যতটা সম্ভব বর্জন করুন।এতে বাড়ির খাবারের প্রতি তার বিশ্বাস তৈরি হবে। পরবর্তীতে সমস্যা হবে না।

শিশুর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ শুরু হয় বাবা-মায়ের পদচিহ্ন অনুসরণ করে।একটি সহজ-সরল জীবন অনুশীলন করা আজকের এই জটিল যুগে সবচেয়ে কঠিন। কিন্তু এই কঠিন কাজটিতেই আপনি কতটা দক্ষ হয়ে উঠছেন, তার উপরই নির্ভর করছে আপনার শিশু কতটা হাসিখুশি হয়ে এগিয়ে যাবে তার পরবর্তী মাইলস্টোনে। (চলবে)

অমিতাভ দাষ।
Child and adolescent counsellor; depression counsellor; psychotherapist.

Related News

Back to top button