আপনার সন্তান কী সফল ভবিষ্যৎ পাবে? এখনই বুঝবেন কীভাবে?

আপনার সন্তানের মার্কশিট কি আপনাকে চিন্তায় ফেলে? সে জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে তো? কিভাবে বুঝবেন এখন থেকেই? কী করণীয় আপনার? একটু পড়ুন। একটু ভাবুন। লিখেছেন অমিতাভ দাষ।
Bengal Live স্পেশালঃ অর্ক ক্লাস সিক্সে পড়ে। পড়াশোনায় খুব একটা ভালো নয়। বাবা ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। মোড়ের মাথায় দোকান। মা গৃহবধূ। লক-ডাউনে অর্ক বাবার ভাঙাচোরা সামগ্রী আর যন্ত্রগুলো ব্যবহার করে একটা কলিং বেল আর একটা লাইট বানিয়েছে, যা হাততালি দিলে জ্বলে, আবার হাততালি দিলে নিভে যায়।
মীরা সেভেনে পড়ে। অঙ্ক- ইংরেজিতে নিয়ম করে প্রতিবার ফেল। বাবা- মা তাকে নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নয় মোটেই। স্কুল না হওয়াতে সে খুব খুশি। বাগান সাজাতে অনেক বেশি সময় পাচ্ছে যে! বাড়ির ভাঙা কাপ-প্লেট দিয়ে সে একটা দশ ইঞ্চি মাপের ভাস্কর্য বানিয়েছে, যেখানে ঝর্ণা, পাহাড়, পাহাড়ি টিলায় দুইটি বাড়ি আর চায়ের বাগান পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ পরীক্ষায় তো নম্বরের বন্যা, কিন্তু জীবন বইবে কোন খাতে ? পড়ুন, ভাবতে সাহায্য করবে
এদের মার্কশিট সাধারণ চোখে দেখলে, এদের খুব খারাপ ছাত্র -ছাত্রী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একটা ছাত্র বা ছাত্রীর ভালো বা খারাপ হবার পেছনে যে যে জিনিসগুলো থাকে, চলুন তো , একবার দেখে নেই, এই দুজনের ক্ষেত্রে সেগুলো কেমন আছে?
প্রথমত, মনোযোগ: বোঝাই যাচ্ছে, এদের দুজনের এটা খুব বেশি পরিমাণেই আছে, নাহলে তারা যা যা করেছে, সেটা সম্ভবই ছিল না।
দ্বিতীয়ত, শেখার ইচ্ছে: শেখার ইচ্ছে না থাকলে অর্ক বা মীরা যা যা করেছে, কোনোদিনই করতে পারত না।
তৃতীয়ত, অধ্যবসায়: লেগে থাকার ক্ষমতা। হার না মানার মানসিকতা।সূক্ষ কাজ করতে এটা সবচেয়ে বেশি দরকার এবং তা এই দুই জনেরই আছে।
তাছাড়াও ধৈর্য্য, মেধা, বুদ্ধিকে বাস্তবে কাজে লাগানোর ইচ্ছে…..এরকম আরো কয়েকটি গুণ এদের আছে এবং বেশি পরিমাণেই আছে। তাহলে এরা কিভাবে খারাপ ছাত্র- ছাত্রী আর এদের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরগুলোই বা এত কম কেন?
এর প্রধান কারণ, এরা হয় চেষ্টা করেনি, বা মুখস্থ করেনি। কেন? উত্তর হতে পারে….আগ্রহের অভাব। কেন অভাব? কারণ বিষয়গুলি বাস্তবভিত্তিক নয়। তারা তাদের স্বাধীন চিন্তাভাবনার আকাশে বিচরণ করতে করতে এই বিষয়গুলোর জালে আবদ্ধ হতে রাজি নয়।
লর্ড মেকলে যখন ভারতবর্ষে তার শিক্ষানীতির প্রবর্তন করেন, সে সময়টা ছিল ভারতে ইংরেজ শাসনের অনুকূলে কেরানি তৈরির সময়।
আরও পড়ুনঃ আপনি কি বোধহীন মাংসের স্তুপ? মোবাইল ফোন ও সম্মিলিত অচেতনতা
১৮৩৫ সালের সেই আইনের কঙ্কাল এখনো বহন করছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটানোর চেয়ে বইয়ের পাতায় যা যা লেখা আছে, সেগুলো হুবহু খাতায় নামানোর ক্ষমতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেক শিক্ষকই আছেন, যাঁরা বলেন, তিনি যা লিখিয়েছেন বা যা অঙ্ক শিখিয়েছেন, হুবহু সেভাবেই লিখতে হবে, অন্য কোনো পদ্ধতি চলবে না। এতেও ছাত্র-ছাত্রীর কাছে ভুল বার্তা যায়।তারা নতুন চেষ্টা করার সাহসই করে না। বর্তমানে বিদ্যালয়ে প্রজেক্ট এ প্রাপ্ত নাম্বার পরীক্ষায় মূল নাম্বারের সাথে যোগ হয়, এটা খুব ভাল ব্যাপার। কিন্তু যে কারণে প্রজেক্ট রাখা হয়েছে, সে উদ্দেশ্য কিন্তু সাধন হচ্ছে না। শিক্ষকরা প্রজেক্ট ব্যাপারটিকে সত্যি কি উদ্ভাবনী ক্ষমতা বৃদ্ধির চাবিকাঠি হিসেবে দেখছেন, না কি সেটাও হয়ে যাচ্ছে “ধর ছাগল পাতা খা” এর মত ব্যাপার।
ছাত্র-ছাত্রীরা ছাগলই বটে। স্কুলে যেতেই হয়। সেখানে এত ছাত্র-ছাত্রীর চাপ। শিক্ষকরা সেখানে তাদের আগ্রহ মেটাতে অক্ষম, এটা শিক্ষকদের সাথে সাথে পিতা মাতারাও ধরে নেন। তাই পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা স্কুলের পরও দিনে গড়ে দুই থেকে তিনটে প্রাইভেট টিউশন। স্কুলেও মূল বিষয়গুলির মধ্যে খেলাধুলার অন্তর্ভুক্তি নেই। নেই কোনো শিল্প ও নান্দনিকতার চর্চা। যতটুকু সাহিত্য আছে, সেটাও নোট মুখস্থ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভাষা শেখানো হয় না ভাষার মত করে। বাংলা ও ইংরেজি সেখানে ভাষা নয়। সাবজেক্ট। তাই উচ্চ- মাধ্যমিক পাশ করেও ভালোভাবে বাংলা লিখতে পারে না। দশ বছর শিখেও ইংরেজি তার কাছে বিদেশি ভাষা। B.A. বা M.A. পাশ করেও তাকে ভর্তি হতে হয় স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসে। ভালোভাবে ভেবে দেখলে একটা বয়সের পর স্কুল যাবার অর্থ সারাদিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হচ্ছে কোনোরকম মস্তিস্কের কাজ ছাড়াই, শুধু অনুসরণ করে। কী ভয়ঙ্কর এই অপচয়, যা হয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম !
দুই থেকে তিন দশক আগেও সরকারি চাকরির ভান্ডার সম্পৃক্ত ছিল না। সেসময় উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য ছিলনা বলে চাকরির ক্ষেত্রে এর প্রভাব ভীষণভাবে পড়েনি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে , শিক্ষাব্যবস্থার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ছে।
তাই এই শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনা করে আপনার সন্তানকে মেধায় ভালো বা খারাপ, এমন কোনো নির্দিষ্ট গন্ডিতে ফেলে দেবেন না। চেষ্টা করুন তাকে উৎসাহ দিতে, যাতে সে তার পছন্দের জগৎ খুঁজে বের করতে পারে, সময় দিন তাকে।
মনস্তাত্বিক এঞ্জেলা ডাকওয়ার্থ, ডেভিড লেভিন এবং ডমিনিক রান্ডলফ আমাদের মোট চব্বিশটি চারিত্রিক শক্তিকে আরো সহজ করে মোট সাতটি বৈশিষ্টে ধরার চেষ্টা করেছেন ভবিষ্যৎ জীবনের সফলতার মন্ত্র। দেখে নিন এই সাতটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আপনার সন্তানের মধ্যে আছে কি না।
আরও পড়ুনঃ আন্তর্জালের ফাঁদে আপনার শিশুর ভবিষ্যৎ আপনিই নষ্ট করছেন না তো ? ভাবুন
এক, অনুসন্ধিৎসা (curiosity) : নতুন কিছু শেখার বা জানার আগ্রহ।
দুই, আশাবাদ (optimism) : খারাপ সময়েও ভালো ভবিষ্যতের কথা ভাবার ক্ষমতা।
তিন, কৃতজ্ঞতা (gratitude) : ভক্তি অথবা উপকার ও সাহায্য স্বীকার করার প্রবণতা।
চার, সামাজিক বুদ্ধিমত্তা (social intelligence) : পরিবর্তিত পরিস্হিতিতে খাপ খাওয়াবার ক্ষমতা।
পাঁচ, উৎসাহ (zest) : নিজে নিজে চেষ্টা করার মানসিকতা।
ছয়, আত্ম- সংযম ( self- control) : নিজের আবেগ ও কর্মকে যেকোনো পরিস্হিতিতে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা।
সাত, একাত্মতার জেদ (grit) : কোনো কাজ শুরু করে শেষ করার প্রবণতা।
এই সবগুলো বৈশিষ্ট্যই কিন্তু চেষ্টার ফলে রপ্ত করা যায় শিশু- কিশোরাবস্থায়। এগুলি জন্মগত হবার ব্যাপার নেই। সবচেয়ে মজা হল এগুলির সবকটিতেই ভীষণভাবে প্রয়োজন পিতা- মাতার সামান্য সময় ও উৎসাহ।
আপনার সন্তানকে দামি উপহার না কিনে দিয়ে, তাকে সময় দিন। চেষ্টা করুন এই গুণগুলি যাতে তার মধ্যে বিকশিত হয়। মার্কশিট এর বোকা বোকা নিস্প্রাণ অক্ষরগুলো আপনার চোখের মনির বড় হবার পথে, যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, তার চেষ্টা শুরু করে দিন আজ থেকেই।