সদ্য রিলিজ হল ওয়েব সিরিজ পাতাল লোক, ছবির আগে চোখ রাখুন এই লেখায়
Bengal Live বিনোদনঃ
এই সময়ের বহুল চর্চিত ওয়েব সিরিজ পাতাল লোক। রিলিজ ১৫ই মে, ২০২০, প্রাপ্তিস্থান অ্যামাজন প্রাইম।। নয়খানা এপিসোড মিলিয়ে প্রায় ৭ ঘন্টা। পাতাল লোক নিয়ে বহুল চর্চার কারন শুধুমাত্র সিরিজ নয়।
সৌম্যদীপ গুহ
এই সময়ের বহুল চর্চিত ওয়েব সিরিজ পাতাল লোক। রিলিজ ১৫ই মে, ২০২০, প্রাপ্তিস্থান অ্যামাজন প্রাইম।। নয়খানা এপিসোড মিলিয়ে প্রায় ৭ ঘন্টা। পাতাল লোক নিয়ে বহুল চর্চার কারন শুধুমাত্র সিরিজ নয়। সিরিজের নেপথ্যে যারা রয়েছেন তারাও অন্যতম কারন। বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অনুষ্কা শর্মা-র ক্লিন স্লেট ফিল্মস প্রোডাকশন দ্বারা নির্মিত এই সিরিজ। ভারতীয় ক্রিকেটের জনপ্রিয় খেলোয়াড় বিরাট কোহলি স্বয়ং ইনস্টাগ্রাম-এ প্রমোশন করছে এই ওয়েব সিরিজটিকে। চর্চার বিষয় তো হবেই। এই সেলিব্রিটিরা তাদের লিভিং রুমের বিশালাকার টিভি স্ক্রিনে পাতাল লোক দেখছে এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় এলে এই সিরিজ না দেখলে যে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স-এ ভুগতে হবে।
পরিচালক অভিনাশ অরুন-এর এটি দ্বিতীয় পরিচালনা। প্রথম ছবি কিল্লা মারাঠি ভাষায় যা জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। অভিনাশ অরুন-এর পড়াশোনা মূলত সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে। ইতিপূর্বে তিনি জনপ্রিয় সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্ব সামলেছেন। মাদারী, দৃশ্যম, মাসান তাদের মধ্যে অন্যতম। পাতাল লোক-এর সিনেমাটোগ্রাফিও তিনি সৌরভ গোস্বামীর সাথে ভাগ করে নিয়েছেন। যার দরুন পাতাল লোক-এ অসাধারণ কিছু রূপক দৃশ্য রয়েছে। শুধু গল্প নয়, ৬-৭ ঘন্টার দীর্ঘ সিরিজে সিনেমাটোগ্রাফি উল্লেখযোগ্য হওয়া ভীষণ প্রয়োজন দর্শকদের উৎসাহ ধরে রাখার জন্য।
পাতাল লোক একটি পলিটিক্যাল বেসড্ ক্রাইম ড্রামা স্টোরি। গল্প লেখকের তালিকা বেশ দীর্ঘ। চারজন লেখকের মস্তিষ্ক প্রসূত গল্প এই পাতাল লোক। এখনকার বেশিরভাগ ওয়েব সিরিজ ক্রাইম স্টোরি বেসড্। সেই জায়গায় ক্রাইম নিয়ে একদম নতুন গল্প দর্শকদের কাছে তুলে ধরা বড় চ্যালেঞ্জ। সিরিজটির শ্যুটিং এক বছর আগের বা বেশি। অর্থাৎ গল্প তারও আগের লেখা। অথচ বর্তমান সময়ে সাংবাদিক অর্নব গোস্বামী ও সুধীর চৌধুরির সাথে সাম্প্রতিক ঘটনার কোথাও মিল পাওয়া যায়। লেখকদের দূরদর্শিতা বাস্তবের সাথে এক দারুণ সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। গল্পের সিংহভাগই ঘোরাফেরা করে প্রধান চরিত্র জয়দীপ এহলাবত ওরফে হাতিরাম চৌধুরির আশেপাশে। সিরিজ হওয়ার কারনে গল্পের অন্যান্য পর্যায়ের চরিত্রদের ডিটেইল দেখানো হয়েছে সুন্দর ভাবে। এবং তাদেরও যথেষ্ট ফোকাস করা হয়েছে।
একটি ওয়েব সিরিজ বা সিনেমা দেখার অনেক ধরণ থাকতে পারে। প্রতিটি মানুষের তার নিজস্ব ভাবনা আলাদা আলাদা হওয়াটাই স্বাভাবিক। মানুষ তার নিজের জীবনে কী ধরণের রাজনৈতিক মতাদর্শ রাখে তা নির্ভর করে এই সিরিজটির ভাল লাগা ও খারাপ লাগায়। বেশিরভাগ ওয়েব সিরিজগুলো তার নিজস্ব গল্পের আঙ্গিকে চললেও মূলত দেখানোর চেষ্টা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, জাতিবাদ, হিন্দু-মুসলিম। কারণ মেনুতে এই আহার পরিবেশিত হলে দর্শকের কাছে তার গ্রহণ যোগ্যতা বাড়ে। পাতাল লোক সিরিজটিও তাই। “হিন্দু-মুসলিম” এই চিরন্তন বিতর্ককে সুড়সুড়ি দিতে ছাড়েননি পরিচালক। তৎক্ষনাৎ তা ঢাকা দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টাও করেছেন সুনিপুণ কৌশলে। হিন্দু-মুসলিম বিতর্ক ভারববর্ষে নতুন কিছু নয়। পরিচালকেরা ইচ্ছাকৃত ভাবেই দু-পক্ষের ভাবনা, মতাদর্শ দর্শকের কাছে তুলে ধরেন না। আপাতদৃষ্টিতে যা কাম্য নয়। নিজের দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি এই দায়িত্বশীলতা কেউ দেখায় না।
পাতাল লোক-এ যে কম্যুনাল অ্যাঙ্গেল দেখানো হয়েছে তা না দেখিয়েও গল্পকে সাবলীল ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। তাতে গল্পে কোনও প্রভাব পড়ত না। পাশাপাশি দেখাতে চাইলে পুরো সত্যতা দেখাতে হত। খুব সন্তপর্নে এই সিরিজে নাম-পদবীর সাথে চরিত্রের সাজুয্যতা রাখা হয়নি। যাতে মশলা না কম পড়ে যায়। সিনেমা পরিচালকদের এই ভাবনা নতুন নয়। ধর্মের আগুন যুগ যুগ ধরে জ্বালিয়ে রাখা হয় নিজেদের স্বার্থে। এবং তাতে সামিল দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে ধর্মের কারবারি সহ সিনেমা বা এই ওয়েব সিরিজের পরিচালকরা।
সিনেমা রিভিউ শুধুমাত্র অভিনয়, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কস্টিউমস, এডিটিং, সাউন্ড-এ সীমাবদ্ধ থাকে না। মূল বিষয় থাকে বক্তব্যে। তথাকথিত সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের ক্রিটিক-রা এই বক্তব্যকে এড়িয়ে আনুষঙ্গিক বিষয়ে আলোকপাত করেন। পরিচালক নিদ্বির্ধায় যখন সেইসব উস্কানি দেয়, প্রপ্যাগান্ডা চালায় তখন দর্শকদেরও সমান অধিকার বর্তায় সে বিষয়ে আলোচনা করার।
সার্বিক ভাবে পাতাল লোক-এর গল্প বেশ ভাল। তাকে এক্সিকিউট বেশ ভাল ভাবে করা হয়েছে। চিত্রনাট্য বেশ মসৃন। এই গল্পে বড় মানের মিডিয়া হাউস, দিল্লির গ্যাংস্টারসহ উত্তর প্রদেশের বাহুবলী সব কিছু সাবলীল ভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। পটভূমি দিল্লি, পাঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশ। প্রত্যেকটি স্থানের ভাষা, সংস্কৃতি সব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভাল লাগে বড় মিডিয়া হাউস ও তার ভেতরের ষড়যন্ত্র থেকে ছোট শহরের মিডিয়ার সাংবাদিকের কাজ করার ধরণ। ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের সাথে তাদের চালিয়ে যাওয়া আমরণ লড়াই। মেয়েরা শুধুমাত্র তাদের শরীরকে ব্যবহার করে সংস্থার বড় পদ পাওয়ার ভাবনা আজ পুরনো। এখন শুধু শরীর নয় সবাইকে নিজ যোগ্যতাবলে এগিয়ে যেতে হয়। এই ভাবনাকে ভাল ভাবে এক্সিকিউট করা হয়েছে এই সিরিজে। মানুষ ও জল্লাদদের মাঝে প্রাণীর ভূমিকা এই সিরিজে উল্লেখযোগ্য। এবং গল্প মোড় নেয় সেখানেই।
এই সময়ের ওয়েব সিরিজগুলো অত্যন্ত রিয়ালিস্টিক ভাবে তৈরি করা হয়। যেইজন্য এই সিরিজগুলো দর্শকদের পছন্দের তালিকায় এখন শীর্ষে। এতে না থাকে অভিনয়ের আতিশয্য, না থাকে অহেতুক মারামারি, না থাকে গাদা গুচ্ছের ইমোশনাল সংলাপ। হাস্যরস থাকলেও তা কখনোই কাতুকুতু দিয়ে নয়। পাশাপাশি প্রত্যেকটি প্রদেশের নিজস্ব ভাষার ব্যবহার মন কাড়ে। কস্টিউমস, মেক-আপ সব কিছুই বাস্তবের সাথে ওতোপ্রোতো। যা এই যুগের সেলুলয়েড প্রাপ্তি। পাতাল লোক সে দিক দিয়ে সব কিছুতেই ওয়েল-মেইনটেইন্ড।
পাতাল লোক-এর প্রধান চরিত্রে পুলিশ ইন্সপেক্টর হাতিরাম চৌধুরি ওরফে জয়দীপ এহলাবত-এর বিকল্প হতে পারেন না। তাঁর হাঁটা-চলা, কথা বলার ধরণ তাঁর চরিত্রকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। নীরাজ কাবি, সঞ্জীব মেহরার চরিত্রে অত্যন্ত সাবলীল। মিরজাপুর-এ কাজ করার পর বিশাল ত্যাগীর চরিত্রে অভিষেক ব্যানার্জি দূর্দান্ত। মিত সংলাপে শুধুমাত্র অভিব্যক্তি দিয়ে সারাক্ষণ সাসপেন্স তৈরি করে গেছে পুরো সিরিজ জুড়ে। যা কঠিনও বটে! এই সময়ের ওয়েব সিরিজগুলোর বড় প্রাপ্তি সহ অভিনেতা-অভিনেত্রী। মেইন স্ট্রিমের সিনেমায় যাঁদের কাস্টিং মেলেই না তাঁরা ওয়েব সিরিজে চুটিয়ে অভিনয় করে দেখিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরাও যোগ্যতা রাখেন। এবং অনেকের থেকে অনেক বেশি।
ক্লাইম্যাক্স-এ কিছু দর্শকের হতাশ হওয়ার পুরো সম্ভাবনা থাকছে। পাতাল লোক ভুলভুলাইয়ার মতো গল্প। শুরু এবং শেষ এক জায়গাতেই। মাঝখানে কেটে যায় প্রায় সাত ঘন্টা। আর ঘটে যায় ঘটনার ঘনঘটা।
সব কিছুর মাঝে বড় প্রাপ্তি জয়দীপ এহলাবত!