বেঙ্গল লাইভ Special

নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি ? জেনে নিন লকডাউনে আপনার শিশুর মন খারাপের দাওয়াই, ভাল থাকার উপায়

বন্ধ স্কুল ও শিশু মন– অমিতাভ দাষ

COVID-19 ও লকডাউন পরিস্থিতির জেরে স্কুল বন্ধ। কবে খুলবে বা খুললেও আপনার সন্তানকে আর স্কুলে পাঠাবেন কিনা, আপনি নিশ্চিত নন। কিন্তু নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির তার মনের অবস্থা কেমন আজকে? কী করবেন আপনি, কীভাবে ভালো রাখবেন আপনার চোখের মণিদের।

Bengal Live স্পেশালঃ আইরিনের কদিন থেকেই মনখারাপ।বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়নি,শরীর ভালোই আছে।লম্বা ছুটি চলছে স্কুলে। কিন্তু রং পেন্সিল অগোছালো পড়ে আছে,পুতুলগুলোকে সাজানো হচ্ছেনা কদিন ধরে।টিভিতে কার্টুন দেখার বায়না নেই।মায়ের ফোনেও হাত পড়ছেনা।মা যখনই আসছেন, দেখতে পাচ্ছেন আইরিন শুয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে,দুচোখে অদ্ভুত চঞ্চলতা কখনো,কখনো শুন্যতা। কিছু জিজ্ঞেস করলে তার আট বছরের মন গুছিয়েও বলতে পারছে না কি হয়েছে??যেন সে নিজেও বুঝতে পারছে না কিছু।

আদৃজার বয়স ছয়,এবছর নতুন স্কুলে যাবার কথা ছিল।শহরের বাইরেই বিরাট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল,বিরাট খেলার মাঠ,বাসে করে বন্ধুদের সাথে স্কুল,মা আর মেয়ের মধ্যে কত কথা হত নতুন স্কুল নিয়ে।কিন্তু স্কুল শুরু হলো কোথায়?কতদিন তো হয়ে গেল।এখন শুধু সকালে দেড় ঘণ্টা মোবাইলে ক্লাস ।সারা দিন এক ভয়ঙ্কর ছুটি।বাবার আপিস খুলে গেছে,মায়েরও facebook আছে।কিন্তু সে কি করবে।কাকাই বাড়ি আর দিদুন বাড়ি যাওয়া নেই,নাচের ক্লাস বন্ধ,বাইরে বেরোনো হয়নি কত মাস।এদিকে দিনে দুই তিন বার মায়ের গালিগালাজ আর মার খাচ্ছে নিয়মিত, তার নাকি মুখে মুখে কথা বলা বেড়ে গেছে,সে নাকি একটুক্ষণ একা ছাড়ে না মাকে।

আরও পড়ুনঃ করোনা – বায়োলজি, বিশ্বপুঁজির খেলা এবং আমাদের অস্তিত্ব

COVID 19 লকডাউন এর প্রভাব এভাবেই পড়ছে শিশুমনের ওপর,তার সঙ্গে চাপ বাড়ছে বাবা মাদের ওপরও।বাচ্চাদের দুস্টুমি বেড়ে গেছে,বেড়েছে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙা।যেসব বাচ্চারা স্কুল আর বাড়ির জীবনের সাথে তাল মেলানোর একটা সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিলো, স্কুল বন্ধ আর বাইরে বেরোনো বন্ধ হওয়ায়, তাদের সমস্যাই বেশি হচ্ছে।
একটু বড়দের নিজেদের জগৎ আছে।

Virtual world এ তারা বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছে।সিনেমা,ওয়েব সিরিজ শেষ হবেনা কোনো লকডাউনেই।কলেজে এবছর ঠিকমত পরীক্ষা হচ্ছেনা প্রায় নিশ্চিত,যারা খুব একটা পড়াশোনা করেনা,তারা এমনিতেই পাশ করে যাবে,আর যারা প্রচুর পড়াশোনা করছিল এতদিন,তারা বুঝে গেছে,এত খাটনি বেকার গেল,এবার গড় নম্বরেই সন্তুষ্ট হতে হবে।

আসলে COVID-19 পৃথিবীতে এতগুলো সমস্যার জন্ম দিয়েছে,যে কলকারখানা বন্ধ,ব্যবসা বাণিজ্যের করুন অবস্থা,যোগাযোগের সমস্যা,
পরিযায়ী শ্রমিক,চীনের পণ্য বর্জন ,দেশের GDP,আরো হাজার আলোচনার মধ্যে আমরা শিশুমনে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘায়িত হরতাল কি প্রভাব ফেলছে,সেটা নিয়ে ভাবার সময়ই পাচ্ছি না।

1951 সালে আমেরিকান লেখক তথা বায়োকেমিস্ট্রি অধ্যাপক আইসাক আসিমভ এর একটি কল্পবিজ্ঞান গল্প THE FUN THEY HAD একটি শিশুপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।পরবর্তীতে গল্পটি এত বিখ্যাত হয়েছিল যে বহু বিজ্ঞান পত্রিকায় এবং অনেক দেশের স্কুল সিলেবাসে গল্পটি বারবার স্থান পেয়েছে।গল্পটি ভবিষ্যতের স্কুল নিয়ে লেখা।

টমি আর মার্জি আগামী পৃথিবীর দুই বাসিন্দা আর প্রতিবেশী যাদের বয়স 12 এবং 13। টমি তাদের বাড়িতে বাতিল জিনিসের স্তুপে একটি অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পায়।তার প্রপিতামহের সময়কার জিনিস সেটি। একটি সত্যিকারের বই।বইটির পাতায় পাতায় অক্ষর ছাপানো আছে।লেখা আছে অতীতের সত্যিকারের স্কুলের গল্প।সেই স্কুল যেখানে শিশুরা ক্লাসরুমে একসঙ্গে ক্লাস করত।ভাগ করে টিফিন খেত।শিক্ষক শিক্ষিকারা ক্লাস নিতেন ক্লাসে এসে,পড়া ধরতেন ।ক্লাস শেষে সবাই স্কুলের মাঠে খেলত ক্লান্ত না হয়ে যাওয়া অবধি। টমি আর মার্জির কাছে বইটা যেন সোনার খনির মত মূল্যবান হয়ে উঠলো।

আরও পড়ুনঃ উদ্ভিদ,ছত্রাকের বৈচিত্র্য জানতে কুলিকে সমীক্ষা,মিলছে নানান অজানা তথ্য

কারণ তারা সেই সময়ের বাসিন্দা যখন বই মানেই কম্পিউটারের স্ক্রিনে লেখা অক্ষর। ই বই বা টেলিবই।আঙুলের স্পর্শে বইয়ের পাতায় যে অক্ষর ছোঁয়া যায়,এই অনুভূতি তাদের প্রথম।আর তাদের স্কুল তাদের বাড়িতেই।পাশের ঘরে।যেখানে একটা স্ক্রিনে হয় তাদের ক্লাস,দিনের নিদির্ষ্ট সময়ে,শিক্ষক সেখানে যন্ত্র,তার কাজ পড়া বোঝানো আর ফ্লপি ড্রাইভে হোমওয়ার্ক নেওয়া।

রক্তমাংসের মানুষ যদি যন্ত্রের কাছে বেঁচে থাকার শিক্ষা পায়,সে শিক্ষা জীবনে কতটা কার্যকরী হবে,সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে বইকি।আমরা কি সেরকমই কোনো ভবিষ্যতের দিকে চলেছি?উত্তরটা কে দেবে বুঝতে পারছি না এই মুহূর্তে।

মানবশিশুর বিদ্যালয় তো শুধুই তাকে পড়তে আর লিখতে শেখায় না,ভবিষ্যত জীবনে বাঁচার জন্যে যে social skill,সামাজিক দক্ষতার শিক্ষা,অন্য মানুষকে বোঝার ও চেনার শিক্ষা,leadership skills বা নেতৃত্বদানের শিক্ষা,আরো বহুবিধ শিক্ষা পায় শিশু তার স্কুল,শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং সতীর্থদের কাছ থেকে।অন্য কোনো সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা এর পরিপূরক হতে পারে,কিন্তু প্রতিযোগী হতে পারবে বলে মনে হয় না অদূর ভবিষ্যতেও।

কিন্তু এই মুহুর্তে আইরিন বা আদৃজা বা সায়নের মত লক্ষ লক্ষ শিশুর কাছে এটাই সবচেয়ে সত্যি যে এভাবেই পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হবে,বাড়ির বাইরে পা রাখা যাবেনা আরো বেশ কয়েক মাস।খেলাধুলো বন্ধ তাই শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হবে,টিভি ,কম্পিউটার মোবাইলের অতিব্যবহারে ক্ষতি হবে চোখ আর মস্তিকের।আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল যে তাদের মনখারাপের খোঁজ রাখবে না তাদের বাবা মায়েরা।তারা জানতেও পারবে না যে এই লকডাউন -মনখারাপ তাদের ভবিষ্যৎ জীবনেও ছাপ ফেলে যাবে।Depression নামক এক মারাত্মক মানসিক অসুখের বীজ বুনে রেখে যাবে এই লকডাউন।

কিন্তু সেসব পরের কথা।এই মুহূর্তে তবে বাবা মায়েরা কি করে খুঁজে আনবে তাদের খোকাখুকুর মনখারাপের দাওয়াই।

প্রথমত: যতটা পারুন টিভি আর মোবাইলের ব্যবহার কমান।প্রয়োজন না থাকলে কম্পিউটার আর মোবাইলে হাত দেবেন না।টিভি দেখার সময় নির্দিষ্ট করে দিন।যখন আপনি গুরুত্বপুর্ন কাজ করছেন,কাজ শুরু করার আগেই বাচ্চাকে বলুন আপনাকে আগামী 1 ঘন্টা বিরক্ত না করতে।এর ফলে সে কাজ আর অবসর বিনোদনের সম্পর্ক আর পার্থক্য বুঝতে পারবে।

দ্বিতীয়ত: তাহলে বাকি সময়টা করবেন কি?ছবি আঁকুন আর রং করুন।আল্পনা আঁকুন খাতার পাতায়।বাচ্চাকে শেখান হরেক রকম নক্সা।রং দিয়ে ভরুন সেগুলি।কালার থেরাপি মানসিক চাপ কমায়।বিভিন্ন রঙের বিভিন্নরকম সাহায্যকারী ফল আছে আমাদের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের উপর।বহু দেশে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন রং এবং আলো ব্যবহার করে মানসিক সমস্যার সমাধান করেছেন।(পড়ুন Sally Augustine,Psychology Today)
Mandala Art এবং বিভিন্ন আল্পনার নক্সা আকার জন্য ইন্টারনেট খুজলেই পেয়ে যাবেন প্রচুর সাইট।(https://design.tutsplus.com/tutorials) রং নিয়ে experiment করুন।আপনি আঁকুন,সন্তানকে বলুন যার যেটি স্বাভাবিক রং হয়না,তার তেমন রং করে দেখতে।যেমন পাতার রং গোলাপি,আকাশ লালচে হলুদ…..ভাবুন আর রঙে ভরুন আপনার আর আপনার শিশুর নতুন পৃথিবী।

তৃতীয়ত: গান শুনুন আর শোনান।গানের ভাষা নিয়ে শিশুর সাথে আলোচনা করুন,তাকে বলুন নিজের ভাষায় গান তৈরি করতে।নিজের গান লেখার জন্য তাকে একটা আলাদা খাতা বা ডায়েরি দিন।।তার মধ্যে এইভাবে ভাষাগত দক্ষতা আর সুর ও ছন্দ বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

চতুর্থত: আপনি আপনার বাচ্চাকে নির্দিষ্ট কাজ দিন।তাকে বলুন ফলের ঝুড়িতে ফল সাজিয়ে রাখতে।ড্রেসিং টেবিল গোছাতে।বই এর খাতাগুলো আলাদা আলাদা করে সাজিয়ে রাখতে।বাটি আর চামচ গুলো গুনে গুনে সাজিয়ে রাখতে বলুন নির্দিষ্ট জায়গায়।ছোট ছোট কাজ দিন তাকে।বলুন আপনি সেগুলো করতে পারেননি,বেশ কঠিন বলে।বাচ্চারা এরকম কঠিন জিনিস যা বড়রা করতে পারেনি,করতে খুব পছন্দ করে।কাজ না বলে সাজিয়ে রাখা বলুন তাকে।আপনি তাকে কাজ দিলে সে নিজের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবে।তার দায়িত্ববোধ তৈরি হবে।

আরও পড়ুনঃ রায়গঞ্জে গণপিটুনি, স্যানিটাইজ, নেতাজিকে অপমান করার অভিযোগ ফরওয়ার্ড ব্লকের, চটজলদি আরও খবর

পঞ্চমত: গল্পের বই পড়ুন ও পড়ান।এর কোনো বিকল্প পাওয়া যায়নি এখনও।শিশুদের কল্পনার জগৎ যদি সমৃদ্ধ না করতে পারেন,আপনার শিশু ভবিষ্যৎ জীবনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে না কখনোই।শুধু মুখস্থ করে,আউরে হয়ত সার্টিফিকেট পাওয়া যায়,বড় ক্রসিং এ রাস্তা পেরোতে কিন্তু জীবনে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাই একমাত্র প্রয়োজন।ভাবুন যেদিন আপনি থাকবেন না,আপনার সন্তান কি চিনে নিতে পারবে জীবনে আগত সমস্যার পায়ের শব্দ?

আপনার সন্তান আপনার সম্পত্তি নয়।এটা বুঝুন।”আপনি তাদের আপনার ভালোবাসা দিতে পারেন,আপনার চিন্তাভাবনা নয়।তারা আপনার সঙ্গে থাকতে পারে কিন্তু তারা আগামী সময়ের সন্তান ।আপনি তাদের আত্মায় নিজেকে বাস করাতে চাইবেন না।”( The Prophet: Kahlil Gibran)
সে আগামী সময়ের নাগরিক। আপনি যে সময়ে মানুষ হয়েছেন,তার থেকে আপনার সন্তানের সময় অনেকটাই আলাদা।প্রতিটি সময়ে একই বয়সের মানুষগুলিরও প্রয়োজন ও চাহিদা আলাদা হয়ে যায়।আপনার বয়সে আপনি যতটুকু জানতেন,সেটা দিয়ে আপনার সন্তানের জানার বিচার করতে যাবেন না।তাকে আলাদা মানুষ হিসেবে গুরুত্ব দিন।তার সাথে কথা বলুন একজন বাড়ির সদস্য হিসেবে।তার যাতে মনে হয় তার মতামতেরও গুরুত্ব আছে।

একইসঙ্গে তাকে এটাও বোঝান যে সবসময় তার পছন্দই সবার পছন্দ হবে,এমনটা নাও হতে পারে।প্রতিটি মানুষ আলাদা,তাদের জগৎ আলাদা,কাজ আলাদা,সে যদি এগুলো বুঝতে পারে,দেখবেন সেও আপনার কাজের সময়কে গুরুত্ব দিচ্ছে।আপনাকে বিরক্ত করছে না।আসলে নিউক্লিয়ার পরিবারে বাচ্চারা ভাবে তার বাবা ও মায়ের পৃথিবী তাকে নিয়েই।তার ওপর Lockdown এর সময় সারাক্ষণ বাবা – মা কে দেখে তার অভ্যেসটাও পাল্টে গেছে।আপনি ওকে ওর নিজের জগৎ তৈরি করে দিন,কল্পনার সাথে সৃষ্টিশীলতা মিশিয়ে; দেখবেন COVID-19 lockdown এর অমাবস্যা পার করে সুন্দরভাবে আপনার সন্তান আবার স্বাভাবিক জীবনের সাথে পা মিলিয়ে চলতে শুরু করেছে নতুন ভবিষ্যতের সূর্যালোকের খোঁজে।

লেখকঃ অমিতাভ দাষ।
পেশায় শিক্ষক,
Child and adolescent counselor,
Addiction counselor, Depression therapist এবং Achology certified Psychotherapist.

Related News

Back to top button